বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অন্যকে সাজানোর কারিগর

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

অন্যকে সাজানোর কারিগর

গয়না গড়লেও নিজেরা সাজেন না। অন্যকে সাজাতে রাতদিন কাজ করে চলেছেন গ্রামীণ জনপদের গয়না তৈরির নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা। তবে নিজে না সাজলেও সংসার সাজিয়েছেন তারা। আর সংসার সাজিয়ে গয়না শ্রমিকরা এখন বেশ ভালোভাবে দিন পার করছেন। শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক অ্যান্টিক ও সিটিগোল্ড গয়না তৈরি করে জীবন-জীবিকা টিকিয়ে রেখেছেন।

জানা যায়, দেশে সোনার দাম বেশ চড়া। চড়া দামে সোনার গয়না কিনে গায়ে পরে কোথাও যাওয়া বা ভ্রমণ নিরাপদ হয় না। রমণী সাজলেও সোনার গয়নার কারণে তাদের অনেকেই থাকেন নানা টেনশনে। এই টেনশন অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে সোনার মতো রং করা বিশেষ ধাতব দিয়ে তৈরি গয়না। সে গয়নাকে বলা হচ্ছে অ্যান্টিক ও সিটিগোল্ড। বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে অ্যান্টিক ও সিটিগোল্ড গয়নার চাহিদা বেড়েছে। আর বেড়ে যাওয়ার কারণে অ্যান্টিক ও সিটিগোল্ড গয়নার শ্রমিকদের কদরও বেড়েছে। গয়না তৈরিকে কেন্দ্র করে বগুড়ার ধরমপুর বাজারে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক দোকান। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের নারী-পুরুষ। অধিকাংশ বাড়িতেই বিভিন্ন ধরনের গয়না তৈরি হওয়ায় এটি গয়না গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। গয়নাশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে অনেকেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। বগুড়া সদর উপজেলার ধরমপুর এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে তৈরি হওয়া গয়নাগুলো হাত বদলে বিক্রি হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বগুড়া শহরের ধরমপুর গ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে ঘরে বসেই অ্যান্টিকের গয়না তৈরি করছেন নারী-পুরুষসহ পরিবারের সদস্যরা। পিতলের দানা, পাত ও তামার তার দিয়ে তৈরি কাঁচামাল থেকে মনোমুগ্ধকর নকশার ডাইসে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের গয়না। সীতাহার, শাড়িমালা, কান্দা, লহর, হাশলি, জড়ো, টায়রা, টিকলি, চূর, বালা, চুড়ি, মানতাসা, নূপুর, বিছাসহ দৃষ্টিনন্দন গয়না তৈরির কাজ করেন তারা। ২০ ধরনেরও বেশি গয়না তৈরি করেন কারিগররা। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গয়নার কাজ হচ্ছে এখানে। আগে পিতলের গয়না তৈরি হতো। পরবর্র্তী সময়ে সোনার গয়না এবং আশির দশকের শেষ থেকে অ্যান্টিক শিল্পের দিকে ঝুঁকতে থাকেন কারিগররা। ২০০৬ সালের দিকে পুরোদমে শুরু হয় অ্যান্টিকের গয়না তৈরি। এ শিল্পে এখন নারী কারিগরদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা পরিবারকে সহযোগিতা করছেন গয়না তৈরির মাধ্যমে। ব্যবসায়ীদের থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা ঘরে বসেই গয়না তৈরি করেন। অনেকে ঘরেই গড়ে তুলেছেন ছোট কারখানা। সেখানে একাধিক নারী তৈরি করেন অ্যান্টিকের গয়না। ধরমপুর থেকে এ শিল্পের বিস্তার সদরের নিশিন্দারা, ঝোপগাড়ী, ফুলবাড়ী, আটাপাড়া, শাখারিয়া, নামুজা, বারোপুরসহ আরও অনেক এলাকায়। এসব এলাকায় নারী-পুরুষ কারিগরদের কর্মসংস্থান হয়েছে। গয়না তৈরির আয় থেকে অনেক নারী সংসারের হাল ধরেছেন। হাতের কাজ করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসারে যেমন সচ্ছলতা এসেছে আবার ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে সঞ্চয় করছেন তারা। শুধু ধরমপুর বাজারে ২ শতাধিক গয়নার দোকান রয়েছে। মালিক-শ্রমিক মিলে এই বাজারে ব্যবসায় জড়িত ২ হাজারেও বেশি মানুষ। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কদর রয়েছে এখানকার গয়নার। গয়না তৈরিতে বগুড়ার ধরমপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ২০ হাজার নারী পুরুষ কাজ করছেন। বগুড়া শহরেও রয়েছে অ্যান্টিকের গয়নার দোকান।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে তারা গয়নার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্বামী-স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা গয়না তৈরি করছে। করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা মন্দা। সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেলেও তারা স্বনির্ভর।

ঢাকার পাইকারি ক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম জানান, দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা থেকে তিনি গয়না কিনতে আসেন বগুড়ায়। দেশি পণ্য হলেও পুলিশের ঝামেলা হয় রাস্তায়।

বগুড়া সদর উপজেলার ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, এখানকার মানুষ আগে সোনার কাজ করতেন। এখন অ্যান্টিকের কাজ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা এখানে আসেন গয়না নিতে। তবে করোনার কারণে ব্যবসা কমে গেছে। এর পরও প্রতি মাসে কোটি টাকার বেচাকেনা হয় বগুড়ার এই গয়নার বাজারে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর