ছয় বছর আগে রাজধানীর রামপুরায় মহানগর আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় খুন হন আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার। ঘটনাস্থলে তাঁর হাত-পা বাঁধা লাশ পড়ে থাকে। ঘটনার এত দিনেও পুলিশ উদঘাটন করতে পারেনি হত্যারহস্য। শুধু ফাহমিদার ঘটনাই নয়, গত আট বছরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া আলোচিত আরও ১৪ হত্যাকান্ড রহস্যের জালে আটকে আছে। মামলাগুলোর তদন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র্যাব ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমে (সিটিটিসি)। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে কমপক্ষে আটটি বাসায় ১৫ জন খুন হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দেয়। গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু এখনো এসব চাঞ্চল্যকর মামলার কার্যক্রম আটকে আছে তদন্ত সংস্থার কেস ফাইলেই। কোনো কোনো মামলায় একাধিকবার তদন্ত সংস্থা বা তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। এর পরও চিহ্নিত হয়নি খুনের হোতারা। তবে মামলার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, কোনোটিরই তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। কিছু কিছু ক্লু ধরে সামনে এগোনো হচ্ছে, তবে রহস্য এখনো উদঘাটন করা যায়নি। আবার কিছু কিছু আসামি চিহ্নিত হলেও পাওয়া যায়নি যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ। তাই রহস্যের জট খুলতে এ দীর্ঘ সময়।
সেই ১৫ খুন : বাসার ভিতর খুনগুলোর মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম একটি হলো ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি খুন। মামলাটির তদন্ত করছে র্যাব। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর হাজারীবাগের বাসায় ১২ বছরের স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবীকে শ্বাস রোধে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট দিনদুপুরে রামপুরার ওয়াপদা রোডের বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি ফজলুল করিমকে। ২১ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার গোপীবাগে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক ও তার ছেলেসহ ছয়জনকে। পরের বছর ২৭ আগস্ট পূর্ব রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন টেলিভিশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। ২০১৫ সালের ১৩ মে পল্লবীতে নিজের ফ্ল্যাটে খুন হন গৃহবধূ সুইটি আক্তার ও তার মামা আমিনুল ইসলাম। একই বছরের ৩০ জানুয়ারি বাসা থেকে উদ্ধার হয় আইনজীবী ফাহমিদা আক্তারের হাত-পা বাঁধা লাশ। ২০১৬ সালের ১ নভেম্বর মগবাজারের মধুবাগে বাসার ভিতর থেকে ডলি রানী বণিক নামে এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনার মধ্যে গোপীবাগের ছয় খুনের মামলাটি তদন্ত করছে সিটিটিসি। অন্য আট হত্যা মামলা থানা পুলিশ থেকে ডিবি হয়ে এখন তদন্তের দায়িত্ব গেছে সিআইডিতে। একটি মামলা তদন্ত করছে র্যাব। এ বিষয়ে অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ তোলা যাবে না। কারণ তদন্ত প্রভাবিত করতে আমাদের দেশের অনেকে চাপ প্রয়োগ করে পুলিশের ওপর। তাই পুলিশের চেয়ে অন্য শক্তির দায় বেশি। প্রায় নয় বছর আগে হাজারীবাগের স্কুলছাত্রী তাসনিম রহমান করবী খুনের মামলার তদন্ত সম্পর্কে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-মেট্রো সাউথ) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, এখন পর্যন্ত ঘটনাটির ক্লু পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের ২৯ মে মামলার তদন্ত আসে তাদের কাছে। তারা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রহস্য উন্মোচনে। ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর মগবাজারের মধুবাগের বাসায় ডলি রানী বণিকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের ৪ মার্চ মামলাটির তদন্ত সিআইডিতে স্থানান্তর হয়। এ মামলার তদন্ত অগ্রগতি সম্পর্কে কামরুজ্জামান বলেন, মামলার তদন্তে কিছু প্রতিবন্ধকতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মামলার বাদী দেশের বাইরে চলে গেছেন। নিহতের বড় ছেলেও কানাডাপ্রবাসী এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিও থাকেন ভারতে। গোপীবাগের ছয় খুন মামলার তদন্তের বিষয়ে সিটিটিসি সূত্র জানান, এ মামলায় এখন পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- হাদিসুর রহমান সাগর, জুলফিকার বিন সাদ ওরফে আবু ওয়াক্কাস, মামুনুর রশীদ রিপন, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে জিতু ওরফে নীরব ওরফে নিয়ন ওরফে হিমু, সৈয়দ আল আমিন, তরিকুল ইসলাম, আবু রায়হান ওরফে মাহমুদ ওরফে আবদুল হাদী, আজমির অমিত ও গোলাম সরোয়ার। আজমির অমিত ও গোলাম সরোয়ার জামিনে আছেন। সাত আসামি কারাগারে। ডিবি পুলিশ তদন্তের সময় গাফফার ও তরিকুল নামে দুজনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে রনি, আতিক, মাহফুজ ও জাহিদ নামে চারজনের তথ্য পায়। কিন্তু তাদের কোনো খোঁজ কিংবা তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এদিকে মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আজ ২৭ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছে আদালত। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, এখন পর্যন্ত ঘটনার রহস্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে সিআইডি সূত্র জানান, এ মামলায় বিভিন্ন সংস্থা আটজনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে দুজন জামিনে বাইরে। অভিযোগপত্র দেওয়ার মতো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার হোতা কে সে বিষয়েও কোনো তথ্য নেই। ফাহমিদা হত্যার তদন্ত সম্পর্কে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-মেট্রো ইস্ট) কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘খুনিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে। আমরা অনেক সূত্র ধরে তদন্ত এগিয়ে নিচ্ছি।’ পল্লবীতে ফ্ল্যাটে জোড়া খুনের ঘটনাটিতেও দীর্ঘ সময় ধরে অন্ধকারে রয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত সম্পর্কে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস-মেট্রো পশ্চিম) সামসুন নাহার বলেন, ‘এখনো আমরা ঘটনাটির কোনো রহস্য খুঁজে পাইনি। তবে আমাদের তদন্তকাজ চলছে’।