মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মৃত ব্যক্তির নামে অ্যাকাউন্ট কোটি কোটি টাকা লোপাট

নাইজেরীয় প্রতারকদের কাণ্ড

মাহবুব মমতাজী

আতাউর রহমান (৫০)। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। পাঁচ বছর আগে মারা যান। মৃত্যুর দুই বছর পর তার নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে অপরাধীরা। ওই অ্যাকাউন্টে এক বছরেই লেনদেন হয় ৬৫ লাখ টাকার বেশি। এমন অস্বাভাবিক লেনদেনে নজর পড়ে গোয়েন্দাদের। জানা গেছে, এমন অসংখ্য ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নাইজেরিয়ান প্রতারকরা। গত বছরের ৫ আগস্ট প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুই বাংলাদেশিসহ চার নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ৭ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। সে সময় টাকা জমা দেওয়ার কয়েকটি ব্যাংক স্লিপ পাওয়া যায়। এ মামলার তদন্ত পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠানো হয়। এর আগে একই বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে এক বাংলাদেশি নারীসহ ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি। পার্সেল পাঠানোর নামে আত্মসাতের লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়।

এসবের মধ্যে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নম্বর হলো- ১৬৪১৫১০৪৪৮৮৭৩। এই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টটি মো. আতাউর রহমানের। সেখানে ইন্ট্রোডিউস অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়েছে তার স্ত্রী মিনাক্ষী সুলতানার। আর আতাউরের অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৬ টাকা। এসব টাকা জমা পড়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মিরপুর-১০ নম্বর শাখায়। ব্যাংকের ওই শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টাকা উত্তোলনের সময় কোনো চেক ব্যবহার করা হয়নি। সব টাকা তোলা হয়েছে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে। শাখার ব্যবস্থাপক মো. মনজুরুল কাদির এ প্রতিবেদককে জানান, যার নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। তিনি তেমন পরিচিত কেউ নন। কিংবা তাকে ব্যাংকে দেখেছি বলে মনে হয় না। অ্যাকাউন্টটি খোলা হয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে। তার অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণে বিএফআইইউ থেকে একটি ইনকুয়ারি দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছেও তাকে ফ্রট টাইপের মনে হয়েছে। যে কর্মকর্তার মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, তার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি- তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের পূর্ব ভুরুলিয়ায়। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। কেরানীগঞ্জে কোন এলাকায় থাকেন। তবে তিনি মারা যাননি। ওই অ্যাকাউন্টের তথ্যের সূত্র ধরে আতাউরের স্ত্রী মিনাক্ষী সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, তার স্বামী কখনো মিরপুর এলাকায় ছিলেন না এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ওই শাখায় কখনো কোনো অ্যাকাউন্ট খোলেননি। ২০১৪ সালে তাদের বিয়ে হয়েছিল। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বামী আতাউর রহমান মারা যান। তবে তার স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে বলে তিনি ব্যাংকের মাধ্যমেই জানতে পারেন।

যে মামলার সূত্র ধরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই নিউটন কুমার দত্ত বলেন, এই জালিয়াতি কীভাবে হলো, ব্যাংক কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই ছাড়াই একজন মৃত ব্যক্তির নামে কীভাবে অ্যাকাউন্ট খুলে দিলেন- সব বিষয় মাথায় রেখে আমরা তদন্ত করছি। নাইজেরিয়ানরা এমন অন্তত অর্ধশত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এবং সেগুলো বিভিন্নভাবে নিজ দেশে পাচার করেছে।

এর আগে গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন রহিমা খাতুন নামে এক নারী। তিনি মামলায় গিফট পার্সেল পাঠানোর নামে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি ও এপিবিএন পুলিশ বিমানবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে জোসুয়া চুকওয়াজিকো নামে এক নাইজেরিয়ানকে আটক করে। এই নাইজেরিয়ান ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৭০১৭৫১৩৩২৪৫৬২ নম্বর অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ওই নারীর কাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই অ্যাকাউন্টটি আমিন গাজী নামে এক ব্যক্তির। ওই অ্যাকাউন্টে মোট ৫ লাখ ৬২ হাজার ৯৮৩ টাকা লেনদেন হয়। মাস দেড়েক আগে আমিন গাজীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তার অ্যাকাউন্ট যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করা হয়েছিল ওই অ্যাকাউন্ট খোলার সময়। কিন্তু ছবি ছিল আরেক ব্যক্তির। কিন্তু আমিন গাজী অ্যাকাউন্টের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। আমিন গাজী বাড্ডা এলাকার ইন্টারনেট ব্যবসায়ী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই অ্যাকাউন্টের বিষয়ে কিছুই জানতাম না। অথচ আমার এনআইডি ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আর ছবিও অন্য ব্যক্তির। পরে ব্যাংকের এজেন্ট কর্মকর্তারা এই ভুলের দায়দায়িত্ব নিয়েছেন। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক নুর আলম শিকদার জানান, নাইজেরিয়ানরা তাদের কোনো চক্র দিয়ে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার টাকা লেনদেন করে। আর টাকাগুলো গার্মেন্ট পণ্যের মাধ্যমে পাচার করে। অ্যাকাউন্টটি বাড্ডার যে এজেন্টে খোলা হয়েছিল ওই এজেন্ট কর্মকর্তা হলেন- আবু সায়েম। কাগজপত্র যাচাই করেছিলেন জাহিদুল ইসলাম এবং যার স্বাক্ষরে অ্যাকাউন্টটি খুলে তার নাম মইনুল কাদের।

সর্বশেষ খবর