রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বস্তি নেই গরিবের আমিষে

মানিক মুনতাসির

স্বস্তি নেই গরিবের আমিষে

গরিবের আমিষ খ্যাত ডিম আর ব্রয়লার মুরগির মাংস তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক আগেই সেঞ্চুরি হাঁকানো মুরগির ডিমের ডজন গতকাল ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৩৫ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১১৫ টাকা। আর দুই সপ্তাহ আগে প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১০৫-১১০ টাকা। আমদানি করা মোটা ডালের কেজি এখন ৯০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৭০-৮০ টাকা। ফলে মন চাইলেই বাজার থেকে এক হালি ডিম, এক কেজি মুরগি কিংবা এক কেজি ডাল এনে পরিবার-পরিজন নিয়ে আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারছেন না দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। এসব সহজলভ্য আর কম দামি আমিষ কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে দিনমজুরদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। পোলট্রিতে প্রায় সব ধরনের খরচ বেড়েছে। ফলে বাড়ছে ডিম ও মুরগির দাম। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আবার দেশ থেকে পাশের দেশে সয়াবিন চলে যাচ্ছে। আর এ সয়াবিন হচ্ছে পোলট্রির খাবার প্রস্তুতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফলে পোলট্রি খামারে ব্যবহৃত খাবারের দাম বেড়েছে। এটি ডিম ও মাংসের উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে। ফলে ডিম ও মুরগির মাংসের দামও বেড়েছে। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিম্ন শ্রেণির মানুষ।

ঘটনা-১ : মিজানুর রহমান। বয়স ৩৬। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকায় রিকশা চালান প্রায় তিন বছর। গ্যারেজেই থাকেন। সেখানেই রাতের খাবার খান। আর সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার টংদোকানের ভুনা ডিম খিচুড়ি। দুই বেলায় ডিম খিচুড়ি কিংবা ডিম ডাল ভাত খেতেন ৬০-৭০ টাকায়। এখন একই রকম খাবার খেতে খরচ হয় ৮০ টাকা। অবশ্য ডাল না খেলে ৭০ টাকায় খেতে পারেন। প্রায় ১০ দিন ধরে দুই বেলার পরিবর্তে এক বেলা ডিম খাচ্ছেন। আর গ্যারেজের মেসে রাতে বয়লার মুরগির মাংস খেতেন। দাম বেড়ে যাওয়ায় তা খাচ্ছেন এক দিন পর পর। এতে তার কিছু সাশ্রয় হচ্ছে, যা গ্রামে থাকা স্ত্রী-সন্তানের জন্য পাঠিয়ে দেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

ঘটনা-২ : সিএনজি অটোরিকশাচালক খোকন মিয়া। রাজধানীর রামপুরায় ঘর ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন। স্ত্রী ঝিয়ের কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। মাঝেমধ্যে সকালে স্কুলগামী দুই মেয়েকে সেদ্ধ ডিম খাওয়াতেন। করোনার কারণে তার আয় কমে গেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ডিম ও মুরগির দাম। ফলে মেয়েদের আলাদাভাবে আর ডিম খাওয়াতে পারছেন না। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে প্রতি হালি ডিমের দাম বেড়েছে ৭ টাকার বেশি। অর্থাৎ এক মাসে প্রতি ডজন ডিমের দাম বেড়েছে অন্তত ২১ টাকা। একইভাবে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১১ টাকা। টিসিবির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গতকাল প্রতি কেজি মোটা ডাল বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ৮০ টাকা। আর গত বছর একই সময়ে এ ডালের দাম ছিল ৬৫ টাকা। শুধু তাই নয়, গতকাল এক লিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকায়, যা এক বছর আগের এই দিনে ছিল ৮৮ টাকা। সে হিসাবে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এক বছরে বেড়েছে ৫৫ টাকা। আর এক মাসে বেড়েছে অন্তত ১০ টাকা। এ তো গেল সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাব। বাস্তব চিত্রে বাজারের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কেননা কেজি বা ডজনের চেয়ে পরিমাণে কম কিনতে গেলে দাম পড়ে আরও বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, সুস্থ থাকার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের বছরে গড়ে অন্তত ২০০ ডিম খাওয়া প্রয়োজন। তবে দেশে মানুষ বছরে গড়ে ১০৫টি ডিম খাচ্ছে। স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এ হার আরও কম। তবে করোনার কারণে ডিমের চাহিদা বেড়েছে। উন্নত বিশ্বের মানুষ বছরে জনপ্রতি গড়ে ৩৬০ থেকে ৩৮০টি ডিম ভোগ করেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন মুরগি, হাঁস, কবুতর ও কোয়েলের প্রায় পৌনে ৫ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। পৃথক হিসাবে কেবল মুরগির ডিম উৎপাদিত হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি। বছরে একজন মানুষের ডিমের চাহিদা কমপক্ষে ১০৫টি। দেশের ১৬ কোটি ৬৬ লাখ জনসংখ্যার হিসাব ধরে চাহিদা অনুযায়ী যে পরিমাণ ডিম প্রয়োজন, এর প্রায় সবটুকুই উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে দেশে। বছরে মাথাপিছু ১০৪টি ধরে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৭৩২ কোটি পিস। চাহিদার বিপরীতে ডিম উৎপাদিত হয়েছে ১ হাজার ৭১১ কোটি পিস।

ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমিষের চাহিদা পূরণে ডিমের চাহিদা অপরিসীম। সম্ভাবনাময় এ খাতটি নানামুখী সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মুরগি পালনের পর ডিম উৎপাদনে ব্যয় অত্যধিক হলেও পর্যাপ্ত দাম মিলছে না। মুরগির খাবারের মূল্য ক্রমবর্ধমান, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে উচ্চ দাম, রোগবালাইয়ে দেদার মুরগি মরলেও ইনস্যুরেন্স বা বীমা না থাকায় খামারিরা পথে বসেন। এতে নতুন করে কেউ আর এ ব্যবসায় পা বাড়াচ্ছেন না, বরং বড় মূলধনের ব্যবসায়ীরা মুরগি চাষ বাদ দিয়ে অন্যদিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পাশের দেশে রপ্তানি হচ্ছে সয়াবিন ও সয়াবিন এক্সট্রাকশন, যা মূলত পশুখাদ্য উৎপাদনের জরুরি উপাদান। ফলে দেশে পণ্যটির দাম বেড়েছে। পোলট্রি খাদ্যের দামও এ কারণেই বেড়েছে, যার ফলে ডিম ও মুরগির দাম বাড়তি। এজন্য প্রাণিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণায়লয়ের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেও কোনো সুরাহা হয়নি। গতকালও এ নিয়ে বৈঠক হয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে।’ এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বরাত দিয়ে ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১০৯৯.৫২ কোটি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১৯১.২৪ কোটি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪৯৩.১৬ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫৫১.৬৬ কোটি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৭১০.৯৭ কোটি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১৭৮১ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়েছে।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের (ডিএলএস) তথ্য বলছে, দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার প্রায় ৪৫ শতাংশ সরবরাহ করছে পোলট্রি খাত। আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৬০-৭০ লাখ মানুষের। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দৈনিক ডিম উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ পিস, দৈনিক মুরগির মাংস উৎপাদন ৩ হাজার টন, এক দিন বয়সী বাচ্চা প্রতি সপ্তাহে উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৮০ লাখ, দৈনিক পোলট্রি ফিড উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজার ৮৬৩ টন। খাতটি ঘিরে ২ শতাধিক শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আশির দশকে বছরে একজন মানুষ মাংস গ্রহণ করত মাত্র ২ কেজি আর এখন তা ছয় কেজিতে উন্নীত হয়েছে। আবার সেই সময় ডিম গ্রহণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮ পিস, এখন তা ১০৫ পিসে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত খামার প্রায় ৭০ হাজার আর অনিবন্ধিত খামার প্রায় ১ লাখ। ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। পোলট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, শিগগিরই পোলট্রি খাবারের কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে একদিকে এ খাতে যেমন বিপর্যয় নামবে, অন্যদিকে আমিষ উৎপাদনে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে দেশ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর