সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাড়াটেরা পারেনি তাই নিজেই খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

ভাড়াটেরা পারেনি তাই নিজেই খুনি

এলিম সরকার। ঢাকার আশুলিয়ার একজন সফল ডিশ ব্যবসায়ী। সরকারবাড়ির হাজি ফজল সরকারের ছোট ছেলে এলিমের বেশ সুনাম এলাকায়। ১৪ বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করেন সুলতানা আক্তার কেমিলিকে। একই এলাকায় কেমিলি তার নানার বাড়ি থেকে যখন লেখাপড়া করতেন, তখন পরিচয় হয়েছিল এলিমের সঙ্গে। তাদের দুই সন্তান। একজনের বয়স ১০, আরেকজনের ছয়। ভালোই যাচ্ছিল সব কিছু। কিন্তু এক সকালের ভয়ংকর একটি ঘটনা সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়।

চলতি বছরের ২৮ মার্চ। শ্বশুরবাড়িতে কাজ আছে বলে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন কেমিলি। স্বামী এলিম সরকার আর দুই সন্তানকে ঘুমে রেখে সকাল ৮টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান সুলতানা আক্তার কেমিলি। বাসার কাছেই শ্বশুরবাড়ি। ১০ মিনিটের পথ। শ্বশুর ফজল সরকারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা শেষে সকাল ১০টার দিকে নিজ বাসার উদ্দেশে রওনা হন। বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকেই চিৎকার দিয়ে ওঠেন কেমিলি। ঘরের খাটের ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এলিম সরকার। পাশের রুমেই ঘুমিয়ে ছিল দুই ছেলে। মায়ের চিৎকারে ছুটে আসে বাবা-মায়ের

বেডরুমে। কেমিলির আর্তনাদে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। খাট রক্তে ভাসছে। এলিমের গলায়, পেটে ও পিঠে ধারালো অস্ত্রের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। লাশ উদ্ধার করে। দুর্বৃত্তরা ঘুমন্ত অবস্থায় এলিম সরকারকে খুন করে পালিয়েছে। স্ত্রী কেমিলির আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে আসে। বারবার জ্ঞান হারান কেমিলি।  এলিম সরকারের বাবা বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু কোনো সূত্র খুঁজে পায় না তারা। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় একজনকে খুন করে গেল কীভাবে? খুনিরা কি তাদের পরিচিত? নাকি ডাকাতদলের কাজ এটি। ডাকাতদলের কাজ হলেও লুটপাট হওয়ার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু লুট হয়নি বাসা থেকে। পুলিশ একদম ধন্দ্বে পড়ে যায়। বাসার সামনে এবং ভিতরেও সিসিটিভি ছিল। খুনিরা সিসি ক্যামেরার ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার) পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। ফলে কোনো ফুটেজও নেই। পরিবারের কাছ থেকেও কোনো তথ্য পাচ্ছে না পুলিশ। কূল-কিনারা হারিয়ে ফেলে খুনের তদন্ত করতে গিয়ে। খুনের পর সপ্তাহ ঘুরে মাস যায়। পুলিশ খুনের কোনো ক্লু খুঁজে পায় না। পুলিশ এলিমের স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে চায়, কোনো শত্রুতা ছিল কি না কারও সঙ্গে। স্ত্রী কেমিলি এক সময় পুলিশকে জানান, তার সন্দেহ ডিশ ব্যবসার কোনো বিরোধ থেকে খুন হতে পারে। বিরোধ কার সঙ্গে? এমন প্রশ্নের জবাবে কেমিলি পুলিশকে বলেন, তার ভাসুর এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন। পুলিশ তার ভাসুর সম্পর্কে তদন্ত করে কিছু খুঁজে পায় না। এভাবেই দুই মাস কেটে যাওয়ার পর এলিম সরকারের পরিবার পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এলিমের বাবা সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কেমিলি তার স্বামীর খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানান। এরপর আরও সময় চলে যায়। কিন্তু পুলিশ কোনো সুখবর দিতে পারে না। তখন এককভাবে কেমিলি আবারও সংবাদ সম্মেলন করেন। এবার তিনি সরাসরি তার ভাসুর সেলিম সরকারকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, তার ভাসুর সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সহায়-সম্পদ দখলে নিতে চান। এসব দখল করতেই খুন করেছেন এলিমকে। আমি তার ফাঁসি চাই। থানা পুলিশ কোনো সুরাহা করতে না পারায় তদন্তের দায়িত্ব পড়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ওপর। পিবিআই তদন্ত শুরু করে। পিবিআই এলিম সরকারের বড় ভাইকে জেরা করে। তার বিরুদ্ধেই কেমিলি অভিযোগ করেছিলেন খুনের বিষয়ে। কিন্তু জেরায় তিনি নতুন তথ্য দেন পিবিআইকে। তিনি বলেন, আপনারা খোঁজ নেন। কেমিলি পরকীয়ায় জড়িত ছিল। তার প্রেমিক মিলে আমার খোট ভাইকে খুন করতে পারে। এমন তথ্য পেয়ে পুলিশ একটু নড়েচড়ে বসে। পিবিআইয়ের নজরদারিতে এবার এলিমের স্ত্রী কেমিলি। পিবিআই এবার খোঁজ নিতে শুরু করে, এলিমের বাড়িতে কারা যেতেন। বেশি কষ্ট করতে হয়নি পিবিআইকে। অনেকের মুখেই একটি নাম ঘুরে-ফিরে উঠে আসে। তার নাম মোহাম্মদ রবিউল করিম পিন্টু। পিন্টু জামগড়া পল্লী বিদ্যুৎ জোনাল অফিসের লাইনম্যান। আশুলিয়ার জামগড়ার বেরন এলাকায় তার বাসা। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের মোবাইল ফোনের হিস্ট্রি খুঁজে বের করেন। মিলে যায় অনেক কিছু। পিন্টুর সঙ্গে কেমিলির ফোনে আলাপ হতো। কিন্তু খুনের ঘটনার পর তাদের সঙ্গে ফোনে একটিবারের জন্যও কথা হয়নি। শুধু তাই নয়, পিন্টু প্রায় নিয়মিত সেই বাড়িতে গেলেও খুনের পর সেখানে আর দেখা যায়নি পিন্টুকে। এসব নিয়ে পুলিশ বুঝতে পারে, তাদের তদন্তটা ঠিক দিকেই যাচ্ছে। প্রায় এক মাস তাদের দুজনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে পিবিআই। একপর্যায়ে পিবিআই নিশ্চিত হয়, খুনি এরাই। খুনের প্রায় পাঁচ মাস পর পুলিশ আশুলিয়ার জামগড়া থেকে এলিম সরকার হত্যার সঙ্গে জড়িত স্ত্রী কেমিলিকে গ্রেফতার করে। পরের দিন জিরাবো এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় পিন্টুকে। পুলিশের জেরায় এরা দুজনই স্বীকার করে যে, খুন তারাই করেছে। তাদের বর্ণনা শুনে পুলিশ কর্মকর্তারাও হতবাক। এলিম সরকারের বাসায় বিদ্যুতের মিটার লাগানোর কাজ করতে গিয়ে পিন্টুর সঙ্গে পরিচয় হয় কেমিলির। ২০১৯ সালের দিকে পরিচয়ের পর তাদের মধ্যে ফোনে কথাবার্তা চলত। এরপর প্রেম, ঘনিষ্ঠতা। এলিমের অনুপস্থিতে বাসায় এসে কেমিলির সঙ্গে মিলিত হতেন পিন্টু। চলছিল এভাবেই নিয়মিত। বিষয়টি আঁচ করতে পারেন এলিম। এ কারণে বাসার বাইরে, এমনকি ঘরের মধ্যেও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন এলিম। এতেও কেমিলি-পিন্টুর পরকীয়া বন্ধ করা যায়নি। তাদের মধ্যে দাম্পত্যকলহ চরমভাবে শুরু হয়। এরপরই খুনের পরিকল্পনা করে কেমিলি-পিন্টু। কেমিলি একদিন পিন্টুকে বলেন, আর ভালো লাগছে না। কিছু একটা কর। আমরা দুজনে সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই। এ কথা শুনে পিন্টু বলেন, ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। খুনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পিন্টু দুজন কিলার ভাড়া করেন। তাদের দুজনকে গার্মেন্ট কর্মীর পরিচয়ে এলিমের বাসার একটি ঘর ভাড়া দেওয়া হয়। সুযোগ বুঝে তারাই খুন করবে এলিমকে। এমন চুক্তি করেন পিন্টু। কিন্তু ভাড়াটে কিলাররা সময়মতো কাজ করতে ব্যর্থ হয়। পিন্টু আর কেমিলি দ্বিতীয় পথ ধরেন। তারাই খুন করবেন এলিমকে। এমন পরিকল্পনা নেন দুজন। ২৭ মার্চ রাতের খাবারের পর দই দেওয়া হয় এলিমকে। সেই দইয়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন কেমিলি। সেটা খেয়ে বেঘোর ঘুমে এলিম। পরদিন সকালে পরিকল্পনা মতো কেমিলি ডেকে আনেন পিন্টুকে। পিন্টুর সঙ্গে ছিলেন আরও একজন সহযোগী। সকাল সাড়ে ৭টায় তারা রুমে ঢুকে পড়েন। স্ত্রী কেমিলি বাইরের দরজায় পাহারায় থাকেন। ভিতরে পিন্টু আর তার সহযোগী ঝাঁপিয়ে পড়েন ঘুমন্ত এলিমের ওপর।

 ধারালো অস্ত্র এলোপাতাড়ি চালাতে থাকেন দুজন। মৃত্যু নিশ্চিত করেই তারা বেরিয়ে যান। আর কেমিলি যান তার শ্বশুরবাড়িতে। ফিরে এসে কান্নার নাটক। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরেই নাটক করে আসছিলেন কেমিলি আর পিন্টু। পিন্টু আর কেমিলি যে আশায় এমন খুনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তা তাদের জন্য এখন অভিশাপ। নিষিদ্ধ প্রেমে মত্ত দুজন সুখের ঘর গড়বেন বলে একজন আরেকজনকে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সুখের ঘর নয়, তাদের কর্মের ফল নিয়ে গেছে কারাগারের ভিতরে। তাদের হয়তো এক সময় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে হবে, নতুবা সারা জীবন কাটাতে হবে অন্ধকার কারাগারে।

সর্বশেষ খবর