শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্বস্তি

বৈশ্বিক সংকট আর আতঙ্কের বছর পার

মানিক মুনতাসির

সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্বস্তি

করোনা মহামারি কাটিয়ে ওঠার আগেই বিদায়ী বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে সংকটের আবর্তে থাকা অর্থনীতিতে শুরু হয় নতুন টানাপোড়েন। হু হু করে বেড়ে যায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম। এরই মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে বৈশ্বিক বাজারে। বাংলাদেশে দাম বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাস্তবিক পক্ষে এই যুদ্ধ যেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে (জ্বলন্ত আগুনে) ঘি ঢালার মতো অবস্থা তৈরি করে। দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে দিশাহারা হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। ফলে ক্রমাগত বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। দুর্দিনের জন্য করা সঞ্চয় ভেঙেও দৈনন্দিন খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় মানুষকে। সরকারের রাজস্ব আদায়ে তৈরি হয় বিশাল ঘাটতি। এতে সরকারের কোষাগারেও অর্থের সংকট দেখা দেয়। বিপাকে পড়ে বাজেট বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজেও নেমে আসে ধীরগতি। সরকার প্রাধিকারের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে থাকে। বাজেট বাস্তবায়নের হার নেমে আসে ১০ শতাংশেরও নিচে। ডলারের সংকট ঠেকাতে প্রায় সব ধরনের বিদেশ সফর স্থগিত/বাতিল করা হয়। আমদানিতে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। অতি প্রয়োজনীয় এলসি খুলতেও অক্ষম হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। এতে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকই নেতিবাচক পর্যায়ে চলে যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনীতির চরম অস্বস্তি নিয়ে বছর পার করতে যাচ্ছে সরকার।

অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে টান পড়তে থাকে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে আসে ৩৩ বিলিয়ন ডলারে। অবশ্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে বাস্তবে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২২ বিলিয়ন ডলারে। যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল পর্যন্ত ইডিএফ ফান্ডসহ রিজার্ভ রয়েছে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আর নভেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় প্রায় ৯ শতাংশে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এই চাপ ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। অবশ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির এই হিসাব অনেকটা বাস্তবতা বিবর্জিত। কেননা যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে তাতে গড় মূল্যস্ফীতির চাপ ১২ শতাংশের ওপরে হওয়ার কথা।

এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে আনতে বাধ্য হয় সরকার। এ ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নকাল পিছিয়ে দেওয়া হয় অর্থের অভাবে। টাকা ছাপিয়ে সংকট সমাধানের চেষ্টা করলেও তা খুব একটা সফল হয়নি। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে না পেরে খাবারের তালিকায় ছুরি বসায় সাধারণ মানুষ। যা এখনো চলমান।

এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে সাত রকমের সংকট রয়েছে। এগুলো হলো- ডলার সংকট, জ্বালানির দর, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, খাদ্য সংকটের শঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা পরবর্র্তী অবস্থা। এসব সংকট কাটাতে সরকারের প্রতি সাত ধরনের সুপারিশ করে সিপিডি। সুপারিশগুলো হলো- পণ্য আমদানিতে কর রেয়াতের সুযোগ রয়েছে, যা বাতিল করা যেতে পারে। এককভাবে বা কয়েকজন মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, যা এক ধরনের শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই সিন্ডিকেটটাকে ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ন্যূনতম মজুরি/বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আয় কমে যাওয়ার কারণে জীবনযাত্রায় তীব্র সংকট বিরাজ করছে। এ সংকট কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য-সংকট এড়াতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। সারের উচ্চমূল্যের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা রয়েছে। এ জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে মন্দার আভাস দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বার বার অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরছে। অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি কমছে, বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে এই সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বছরের প্রায় শুরুর দিক থেকেই ডলারের বাজারে রীতিমতো পাগলা ঘোড়া ভর করে। এতে ক্ষণে ক্ষণে ডলারের দর পরিবর্তন হতে থাকে। বাড়তে বাড়তে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ছাড়িয়ে যায় ১২০ টাকা। এখনো খোলা বাজারে ১১২/১১৩ টাকার নিচে ডলার পাওয়া যায় না। যদিও আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে আমদানি খরচ নামিয়ে আনা হয়েছে অর্ধেকে। এরপরও ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অবশ্য ব্যাংক রেট, খোলা বাজারের রেট, রেমিট্যান্স খাতের রেট ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় বাজারে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। এদিকে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় সরকার। এতে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায় লোডশেডিং। খাদ্য সংকট এড়াতে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাদে প্রায় সব ধরনের আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। বছরের শুরু থেকে শেষ অবধি এই ধারাই চলমান। তবে নভেম্বর থেকে শীতকাল হওয়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। ফলে বছরের শেষদিকে এসে লোডশেডিংও নেমে এসেছে সহনীয় পর্যায়ে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর