ইউক্রেন যুদ্ধের পরও রপ্তানি আয়ে রেকর্ড হয়েছে; বেড়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। তারপরও ডলার সংকটের কারণে বছরজুড়েই পণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এলসি জটিলতায় উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনতে পারেননি বিদেশ থেকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্পোৎপাদন। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। দ্রব্যমূল্য কমাতে সরকারের সংস্থাগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমেনি।
পোশাক রপ্তানির ওপর ভর করে দেশের ইতিহাসে গত নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের মাইলফলক অর্জন করে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী গত মাসে ৫ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো এক মাসে এত বেশি পরিমাণ রপ্তানি আয় আর আসেনি কখনো। এর আগে এক মাসে সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানির রেকর্ড ছিল ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের। গত বছরের ডিসেম্বরে এই রেকর্ড হয়েছিল। এ বছরের নভেম্বরে এসে সেই রেকর্ড ভেঙে যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ ও জ্বালানি সংকটের কারণে যেখানে দেশের কারখানাগুলো উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছে, সেখানে রেকর্ড পরিমাণ রপ্তানি আয় অর্জিত হওয়ার বিষয়টি অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বরং ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির এলসি জটিলতার বিষয়টিকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করছেন।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সভায় এলসি জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। আগামী রমজানে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি জটিলতা দূর করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই সংকটের সমাধান না হলে ভোগ্যপণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে।সূত্র জানায়, সভায় একটি ভোগপণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াজাতকারক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি জানান, তাদের কোম্পানি ২৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুললেও তা নিষ্পন্ন করতে পারছেন না। এর ফলে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। বাংলাদেশের অনেক কোম্পানির এলসি বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা। সভায় এলসি জটিলতা দূর করে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান। এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি শফিউল আলম মহিউদ্দিন এলসি জটিলতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অর্থ পাচারের অজুহাত দিয়ে ঢালাওভাবে এলসি বন্ধ করা যাবে না। যারা টাকা পাচার করে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক। তবুও সহজে এলসি করার সুযোগ দিতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়ার কথা জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ জেনে এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানিতে সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে পণ্য আমদানির এলসি সহজ করতে বলা হয়েছে। রোজার সময় কোনো পণ্যের যাতে ঘাটতি না হয় এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকে সে জন্য তেল, চিনি, ডাল ও ছোলার এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, রমজান সামনে রেখে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ ৮ পণ্যের আমদানিতে এলসি মার্জিন বা নগদ জমা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা এবং এসব পণ্য ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। আরেক প্রজ্ঞাপনে এলসি মার্জিনে ছাড় দেওয়ার তালিকায় যুক্ত হয় চাল ও গম। ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এসব সুবিধা আগে থেকেই আছে বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, শুধু মার্জিনে ছাড় দিলে হবে না, আমদানিকারকরা ব্যাংকগুলোতে এলসি করতে গিয়ে যাতে প্রয়োজনীয় ডলার পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।