যে বয়সে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সেই কিছু শিশু-কিশোর অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া অপরাধমূলক কর্মকান্ডগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, উঠতি বয়সের ছেলেদের একটি অংশ বিশেষ করে কিশোররা এসব কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যবেক্ষণ বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে এই কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আগের তুলনায় বেড়েছে।
দেশের কিশোর গ্যাং নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দারিদ্র্যতা, শিশুর ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, মা-বাবার মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিবাহবিচ্ছেদ, অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা, অপরাধপ্রবণ ভাই-বোন বা বন্ধুদের সঙ্গ এবং অতিরিক্ত মাদকাসক্তি- ইত্যাদির ফলে শিশু-কিশোররা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, প্রযুক্তির অপব্যবহার, নেতিবাচক খ্যাতির মোহ, সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধ, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শিশু-কিশোরদের অপরাধী করে তুলছে। চলতি বছরের এপ্রিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া এক বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সারা দেশে এখন ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ে সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব গ্যাংয়ে আছে ৩১৬ জন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও গাজীপুর, খুলনায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সক্রিয় আছে। ধীরে ধীরে দেশের জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোর গ্যাংয়ের যে কালচার এখন দেখা যাচ্ছে শুরুতে তা ছিল কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক। পরে মেট্রোপলিটন-কেন্দ্রিক বিস্তার লাভ করে। মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররাই অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের খুব একটা অপরাধে জড়াতে দেখা যায় না। ঢাকার বস্তিকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে কিশোররা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং উত্তরা এলাকায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেশি। সাধারণত একটি এলাকায় যখন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠে তখন পাল্লা দিয়ে আরেক এলাকাতেও কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে।
‘জুভেনাইল ডেলিকুয়েন্সি, ইটস কজেস অ্যান্ড জাস্টিস সিস্টেম ইন বাংলাদেশ : এ ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা হত্যা, মারামারি, চুরি-ডাকাতি, পকেট কাটা, যৌন হয়রানি ও প্রতারণামূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র পরিবারের যেসব শিশু সমস্যাযুক্ত হয়ে বেড়ে উঠে, তারা সাধারণত ডাকাতি, ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অভিভাবকদের সন্তানের ওপর নজরদারির অভাব, কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, মা-বাবার দ্বন্দ্ব বা বিবাহবিচ্ছেদ, অপরাধপ্রবণ ভাই-বোন বা বন্ধুদের সঙ্গ শিশুদের মধ্যে অপরাধ মানসিকতা তৈরি করে। আবার যে শিশু সিঙ্গেল মা-বাবার নজরদারিতে বেড়ে উঠে তার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি।
‘ফ্যাক্টরস অব জুভেনাইল গ্যাং কালচার ইন বাংলাদেশ : এন ইনভেস্টিগেট স্টাডি ইন ঢাকা’ শীর্ষক আরেক গবেষণায় বলা হয়, কিশোরীদের তুলনায় কিশোররা বেশি কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বেশির ভাগের বয়স ১৮-এর নিচে হলেও অনেকের বয়সই ১৮-এর ওপরে। একেকটি গ্রুপে সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ জন সদস্য থাকে। এসব গ্যাংয়ের নামগুলো বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে গ্যাংয়ের অস্ত্র বেশি তারা বেশি ক্ষমতার প্রদর্শন বা সহিংস কর্মকান্ডে জড়িত। কিছু গ্যাং আবার দেয়ালে লোগো বা গ্রাফিতি এঁকে নিজ এলাকা নির্ধারণ বা চিহ্নিত করে। সাধারণত অস্ত্র হিসেবে তারা কুড়াল, চাপাতি, রামদার মতো দেশি অস্ত্র ব্যবহার করে। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে যে অর্থ তারা পায় তা অবৈধ জুয়া ও মাদক ক্রয়ে ব্যয় করে। গবেষণা কাজের সময় কিশোর গ্যাংয়ের অনেক সদস্য জানায়, তারা খ্যাতির জন্য অনেক সময় সহিংস কর্মকান্ডে জড়ায়। অতিরিক্ত মাদক গ্রহণের কারণে কিশোর অপরাধীদের অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। কিশোর অপরাধীদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে দেশে অস্ত্রের সহজলভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকেও তাদের রক্ষা করে। এর বিনিময়ে এ কিশোররা তাদের রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে চাঁদাবাজি, দখলদারি ও এলাকা নিয়ন্ত্রণ রাখার মতো কাজগুলো করে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের কাজেই প্রভাবশালীরা কিশোর অপরাধীদের বেশি ব্যবহার করছে। বিগত কয়েক বছরের অপরাধের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক সেবন ও মাদক বিক্রয়ের মতো অপরাধগুলোতেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। টিকটক, লাইকি, ইমো ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক ব্যবহারও কিশোর অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। একটি ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, সাভার পৌর এলাকার মধ্যপাড়া মহল্লায় গত ১ নভেম্বর রাতে সুশীল রাজবংশী একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন। এ সময় এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য গণেশ (২২) প্রকাশ্যে ছুরি নিয়ে ঘুরছিল। এ সময় সুশীল তাকে ছুরি নিয়ে ঘুরতে নিষেধ করেন। এতে গণেশ উত্তেজিত হয়ে সুশীলের ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। পরে রত্তাক্ত অবস্থায় সুশীলকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আরেক ঘটনা অনুযায়ী, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এতে নাসির বিশ্বাস (৩০) ও মুন্না (২২) নামে দুজন নিহত হন। স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রায়েরবাজার এলাকার কিশোর গ্যাং লিডার এলেক্স ইমনের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাং গ্রুপের দেড় শতাধিক সদস্য কবরস্থানের ভিতর থেকে তিন চারজনকে ধরে নিয়ে আসে আজিজ খান রোডে। এ সময় তিনজনকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে নাছির ও মুন্না ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানা প্রতিকূলতার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের ওপর পর্যাপ্ত নজরদারি করা যাচ্ছে না। দেশে চলমান অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারি বেশি থাকায় এটি হতে পারে। তবে শিগগিরই এ বিষয়ে যারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আছেন তারাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নজর দেবেন এবং কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এনে বিষয়টি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবেন বলে আশা করছি।