শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সীমানা পেরিয়ে বাংলা ভাষা

জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তব্যরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান - জাপানে শহীদ মিনার

পৃথিবীর বুকে মোট ভাষার সংখ্যা নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া বেশ দুরূহ। দ্রুত নগরায়ণ, আধুনিকতা, প্রতিযোগিতা, অন্যের সংস্কৃতি, ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনসহ নানাবিধ কারণে প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে বহু ভাষা। ভাষাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এথনোলগের তথ্য মতে পৃথিবীতে বর্তমানে ৭১১১টি ভাষা রয়েছে। তবে এসব ভাষার মধ্যে ৯০ শতাংশ ভাষা ব্যবহারকারীর সর্বমোট সংখ্যা প্রায় এক লাখ মাত্র। এই এক লাখ বাদে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা বা প্রায় ৭৭৭ কোটি মানুষ পৃথিবীতে বিরাজমান ১০ শতাংশ ভাষায় বা ৭১১টি ভাষায় কথা বলে। (সূত্র : দ্য ইন্টিপ্রিড গাইড) এথনোলগের অপর তথ্যে দেখা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে, যার সংখ্যা ১১৩ কোটির বেশি। এরপর রয়েছে ম্যান্ডারিন চাইনিজ, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফ্র্যাঞ্চ ও আরবি ভাষা। এই ধারাবাহিকতায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলা ভাষা। যে ভাষায় কথা বলে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ। তবে অন্য ভাষার সঙ্গে বাংলার পার্থক্য হলো, এই ভাষাকেই দাফতরিক ভাষা মর্যাদা প্রদানের দাবিতে সংগ্রাম করে বাংলায় কথা বলা মানুষ। আর এই সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয় বাংলার দামাল ছেলেরা। তাই পৃথিবীর সব মাতৃভাষা বা আদি ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমেই উচ্চারিত হয় ‘বাংলা’ ভাষার কথা এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি। এ ছাড়াও এ সংগ্রামের কারণে আহত ও মামলা-মোকদ্দমার শিকার হন অসংখ্য বাঙালি। তাই একুশ একদিকে যেমন শোকের অন্যদিকে তেমনি অহংকারের। এই অহংকারে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার, শহীদ মিনার নির্মাণ, স্কুল স্থাপনসহ নানামুখী কর্মকান্ড।

 

পবিত্র ভূমিতে বাংলা

বিশ্বের বুকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় জমায়েত হয় মরুর দেশ সৌদি আরবে। প্রতি বছর পবিত্র হজ উপলক্ষে কয়েক লাখ মুসলমান নারী-পুরুষ সমবেত হন মক্কা, মদিনা, আরাফাতের ময়দান, মিনাসহ বিভিন্ন পবিত্র স্থানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকেও লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতি বছর একটা দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন সৌদি আরবে। বাংলা ভাষাভাষী এসব আল্লাহর মেহমানের সুবিধার্থে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা ও সতর্কতামূলক ব্যানার বাংলায় লিখা হয় এবং উল্লেখযোগ্য অংশে প্রদর্শন করা হয়। এ ছাড়াও বাংলা ভাষায় লেখা করণীয় ও বর্জনীয় উপদেশ এবং কিছু সতর্কতামূলক উপদেশ লিফলেট বা প্রচারপত্র আকারে বিতরণ করা হয়। বাংলা ভাষায় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর লেখা কিছু পাতলা বইও বিতরণ করা হয়। সৌদি সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলায় লেখা পবিত্র কোরআন শরিফের তাফসির বিনামূল্যে বিতরণ করে চলেছে। মক্কা, মদিনা ও মিনাসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বাংলাদেশের হজ মিশনের অফিস ও মেডিকেল সেন্টারে স্থায়ীভাবেই বসানো হয়েছে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড। বাংলায় লেখা সবচেয়ে বড় সাইন পোস্ট বা বোর্ড দেখা যায় মদিনা শরিফের নিকটবর্তী ‘জান্নাতুল বাকি’ নামক কবরস্থানে। পবিত্র এই কবরস্থানে অনেক নবী, সাহাবি এবং মহানবী (সা.)-এর নিকটাত্মীয়ের কবর রয়েছে। এসব কবরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের নামে সীমা লঙ্ঘন বাড়াবাড়ি প্রতিরোধের উদ্দেশে বড় এবং সুউচ্চ সাইনবোর্ডে কবর সম্পর্কিত কিছু জরুরি তথ্য ও দিকনির্দেশনা এবং কবর সম্পর্কিত কিছু নিষিদ্ধ বিষয়, শিরোনাম, বাংলায় কিছু তথ্য লেখা রয়েছে।

 

তিন দেশের দাফতরিক ভাষা বাংলা

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এ মাটির সূর্য-সন্তানরা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেদিনের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ বাংলায় কথা বলে এবং লেখালেখি করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পর ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান-পরবর্তী ১৫ বছর ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত ইংরেজি দাফতরিক ভাষা ইংরেজিকে ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বহু ভাষাভাষীর দেশ ভারতে মোট ২২টি ভাষাকে বিভিন্ন রাজ্যে দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করা হয়। ভারতীয় সাংবিধানের অষ্টম অধ্যায় এই ২২টি ভাষার রক্ষাকবচ। তবে ভারতের সার্বিক দাফতরিক কর্মযজ্ঞে পরিচালিত হয় ইংরেজি ও হিন্দিতে। সাংবিধানিক স্বীকৃত ২২টি আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলা ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা আসামের বোরাক উপত্যকা, বোদো ও টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল নাম শহরেও দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলা সমাদৃত। এ ছাড়াও রাজ্য সরকারের কাজে ঝাড়খ- এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সাংবিধানিক অনুমতি রয়েছে।

 

বাংলাদেশ এবং ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশের জনগণ বাংলায় কথা বলার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এতদসত্ত্বেও পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়ন ২০০২ সালে বাংলাকে দেশটির দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর নেপথ্যে রয়েছে দেশটিতে বিরাজমান গৃহযুদ্ধের অবসান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান সেনাদের অবদান। ১৯৯১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত টানা একযুগ সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের মাঝে দাঁড়িয়ে এবং জীবনবাজি রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ছিল বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রায় ৫৩০০ সদস্য। পৃথিবীর ৩১টি দেশের প্রায় ১৭ হাজার শান্তিরক্ষীর মধ্যে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের স্থান সবার ওপরে। অন্যদিকে সব ধরনের বিতর্ক এবং লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে জয় করে স্থানীয়দের হৃদয়। ২০০২ সালের ১৮ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘোষণা করা হয়। একই বছর বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সেবা ও পুনর্গঠনমূলক কাজের অংশ হিসেবে নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহাম্মদ তেজান কাবাহ দেশে বিরাজমান অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি ‘বাংলা’কে দেশটির সম্মানসূচক ‘দাফতরিক ভাষার’ ঘোষণা দেন বলে গণমাধ্যমে উঠে আসে। দালিলিকভাবে সে দেশে বাংলার প্রচলন না থাকলেও শান্তিরক্ষীদের পাশাপাশি থাকা বা সহযোগিতা হিসেবে কাজ করা অসংখ্য নারী, পুরুষ এবং কৌতূহলী শিশুরা অনায়াসে বাংলা ভাষা রপ্ত করে। বাংলাদেশের মানুষকে কাছে পেলে এখনো তারা হাসিমুখে বাংলায় কথা বলে।

 

কালো মানুষের কণ্ঠে বাংলা

সিয়েরা লিয়নের বাইরেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী পৃথিবীর পাঁচটি বৃহৎ অঞ্চলের ২৫টিরও বেশি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ অবদান রেখেছে। এরমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতময় অঞ্চল আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা, রুয়ান্ডা, আইভোরিকোস্ট, ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া, মধ্য আফ্রিকা, চাঁদ, লাইবেরিয়া, বরুন্ডি, মোজাম্বিক, সোমালিয়া ও সুদানে ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশি সৈন্যের উপস্থিতি এবং দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান সার্বিকভাবে বৃহত্তর আফ্রিকায় বাংলা ভাষা, জীবনাচার, সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস প্রভৃতিকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে।

বাংলাদেশি সৈন্যরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় দিবস এবং ধর্মীয় উৎসবে অনাড়ম্বরভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। এসব সাংস্কৃতিক আয়োজনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ বা আকর্ষণ হিসেবে থাকে আফ্রিকার কালো মানুষের সুললিত কণ্ঠে মিষ্টি বাংলা গান এবং বাংলা গানের সুরে দেশীয় মুদ্রায় আফ্রিকানদের নাচ। এর মধ্যে বাউল আবদুল করিমের ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ এবং শিল্পী শিরিনের গাওয়া ‘রসিক দিলকা জ্বালা, ও লাল কুর্তাওয়ালা’। গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমাদের জাতীয় অনুষ্ঠানের মঞ্চে আফ্রিকার তরুণ সমাজের কণ্ঠে কবিগুরুর লেখা আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। আর গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই গানের সঙ্গে সিয়েরা লিয়নের বিভিন্ন বয়সী মানুষের অভিনয়ও ঝড় তোলে কোটি বাঙালির হৃদয়ে।

 

জাতিসংঘে বাংলা

বিশ্ব সংস্থা ‘জাতিসংঘ’ ছয়টি ভাষাকে দাফতরিক ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এগুলো হলো- আরবি, চাইনিজ, ইংরেজি, স্পেনিশ, ফ্র্যাঞ্চ ও রাশিয়ান ভাষা। এই ছয়টি ভাষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণের জন্য ছয়টি পৃথক তারিখও রয়েছে জাতিসংঘে। এর মধ্যে ইংরেজি ও ফ্র্যাঞ্চ ভাষায়ই চলে মূল দাফতরিক কাজ। এর বাইরে বাংলা, হিন্দি, মালয়, পর্তুগিজ, সিংহলি ও তুর্কি। এ ছয়টি ভাষাকে জাতিসংঘের দফতরিক ভাষা করার প্রস্তাব করেছে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে নতুন মর্যাদায় ঠাঁই দিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো তিনি বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে বাংলার জয়ধ্বনি শুনিয়ে দেন। ৫০-এর দশকে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে সংগ্রামে তিনি নেমেছিলেন সেই বাংলাকেই যেন বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে নতুন সংগ্রামে নামেন এই মহাপুরুষ। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁর নির্মম হত্যাকা-ের পর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ নির্বাসিত ছিল দীর্ঘদিন। পরবর্তীতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর পুনরায় বাংলায় ভাষণ দেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে। ধারাবাহিকভাবে তার বাংলা ভাষণ ক্রমাগত বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ব নেতাদের আগ্রহ বৃদ্ধি করছে। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল এডুকেশনাল, সাইন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন’ (ইউনেস্কো) বাংলা ভাষায় প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ, ১৯৭১-এর ভাষণ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ অন্তর্ভুক্ত করেছে। যা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত সংস্থাটির ৩০তম অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে সারা পৃথিবী নতুন করে বাংলা ভাষার দাবিতে জীবন উৎসর্গ করার ইতিহাস জানতে পারে। পরের বছরই ২০০০ সালে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পালন শুরু করে। যার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইউনেস্কো এ উপলক্ষে দারুণ সব পোস্টার প্রকাশ করে।

 

প্রবাসে বাংলা স্কুল

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ দেশের বাইরে প্রায় ৯৮টি দেশে প্রবাসী জীবনযাপন করছে। সরকারি হিসাবে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তবে বাস্তবে তা আরও বেশি বলে অভিমত অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের। এই প্রবাসীদের একটি অংশ আবার স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থী, যাদের অনেকের জন্ম বিদেশের মাটিতে। বাবা-মায়ের হাত ধরে বিদেশে পাড়ি জমানো শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও কম নয়। স্কুল ও কলেজগামী এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিদেশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ‘বাংলাদেশ স্কুল’, যা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত। এসব স্কুলে বাংলাদেশের মতোই দেশীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে ইংরেজি ভার্সন অনুসরণের প্রবণতা বেশি। তবে বোর্ডের পরীক্ষার অংশ হিসেবে তাদের বাংলা বিষয়ে পড়া বাধ্যতামূলক। অনেক ‘বাংলাদেশ স্কুল’ ব্রিটিশ পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে এবং শিক্ষার্থীরা এসএসসির স্থলে ও লেভেল এবং এইচএসসির স্থলে এ লেভেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমেও ‘বাংলা’কে একটি ভাষা হিসেবে পড়ার এবং বাংলা বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। পাঠক্রমের শিক্ষার বাইরে সহপাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা কবিতা, গান, নাচ, চিত্রকলা, অভিনয়, কারুশিল্প প্রভৃতি চর্চার প্রচলন রয়েছে। বেশ গুরুত্ব দিয়েই এসব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় দিবসগুলো, যেমন : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতীয় শিশু দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ, ঈদে মিলাদুন্নবী ইত্যাদি উদযাপিত হয়। বর্তমানে কাতারের দোহা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাইস আল খাইমা ও আবুধাবি; সালতানাত অব ওমানের মাস্কাট, সিনাও, সাহাম, সোহার ও জালান; সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম; লিবিয়ার ত্রিপোলি এবং বাহরাইনের সালিহিয়া শহরে বাংলাদেশ স্কুল রয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, পরিচালনা পর্ষদের কোন্দলে বন্ধ হয়ে গেছে দুবাইসহ আরও কিছু বাংলাদেশ স্কুল।

 

 

দেশে দেশে শহীদ মিনার

ভাষা শহীদদের অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বাংলাপ্রেমীরা দেশের বাইরেও গড়ে তুলেছেন বেশ কিছু শহীদ মিনার। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের বোস্টনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অর্থায়ন ও উদ্যোগে সে দেশে প্রথম একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির পিটারসনে অবস্থিত ওয়েস্ট সাইড পার্কে উদ্বোধন করা হয় দ্বিতীয় শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থানীয় পাসাইক কাউন্টি দেড় লাখ ডলার এবং পিটারসন সিটি কাউন্সিল ১৩৯ প্রিকনিয়াস এভিনিউ ওয়েস্ট সাইড পার্কে জমি বরাদ্দ করে। ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার। লন্ডনস্থ বরো অব টাওয়ার হেমলেটস, বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (ইউকে) এবং ৫৪টি বাংলাদেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই শহীদ মিনার স্থাপন করে। একই আদলের একটি শহীদ মিনার রয়েছে মরুর মুসলিম দেশ সালতানাত অব ওমানের বাংলাদেশ স্কুল মাস্কাট প্রাঙ্গণে। সমগ্র ধর্মীয় গোরামির ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাপ্রেমী এবং মাতৃভাষাপ্রেমী ভিনদেশিদের পুষ্পার্ঘ্যে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভরে উঠে শহীদ মিনারের বেদি। ২০০৬ সালে বাংলাপ্রেমী ওমান প্রবাসী একদল সংগঠকের উদ্যোগে গড়ে ওঠে এই শহীদ মিনার। একই বছর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত বিশ্বঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য বিখ্যাত অ্যাশফিল্ড পার্কে নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত প্রায় সাড়ে ১২ হাজার অস্ট্রেলিয়ার ডলারসহ মোট প্রায় ৪০ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার ব্যয়ে এই শহীদ মিনার নির্মিত হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মূলভাব ধারণ করে মা-রূপী একটি বড় স্তম্ভ এবং সন্তান রূপী চারটি ছোট স্তম্ভ নিয়ে জাপানের তোশিমা শহরের ইকেবুকোরো ওয়েস্ট এক্রিট পার্কে নির্মিত হয় একটি আকর্ষণীয় শহীদ মিনার। জাপানস্থ বাংলাদেশ সোসাইটি একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে এই শহীদ মিনার অঙ্গনে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস, প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাতেগড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বাংলা চর্চার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা স্কুলগুলো একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি তৈরি করে এবং ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। এমনিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সারা বিশ্বে বাংলার আবহে ভাসায় বাংলাপ্রেমী বাঙালিরা।

                লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর