রাজনৈতিক দল ও সব সামাজিক পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় এবং যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে কার্যকর সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করাসহ ১৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেছে ১২-দলীয় জোট।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১২-দলীয় জোট আয়োজিত ‘দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি ও জনগণের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা।
সংবাদ সম্মেলনে ১২-দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, আমাদের ১২ দলের পক্ষ থেকে এবং প্রকৃতপক্ষে এই দেশের সমস্ত গণতন্ত্রকামী জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের একটাই দাবি, সেটা হচ্ছে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের ঐক্য। এই ঐক্যই দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারবে। ১২-দলীয় জোটের প্রস্তাবগুলোর অন্যতম হচ্ছে, প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের যেসব দোসর কর্মরত আছেন তাদের অপসারণ, জেলা প্রশাসক নিয়োগে নতুন ফিট লিস্ট এবং যেসব জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের নিয়োগ বাতিল ও ফ্যাসিবাদের সময়ের চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দু-একজন বিপ্লব-গণ অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ব্যাহত করছে, তাদের সরাতে হবে এবং গত ১৫ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পিলখানা ও শাপলা চত্বরের গণহত্যার পৃথক বিচার কমিশন গঠন এবং বিডিআর বিদ্রোহের প্রকৃত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ ও নির্দোষ জওয়ানদের মুক্তি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার অপরিসীম ত্যাগ, রক্তদান ও জীবনের বিনিময়ে যে স্বপ্ন ও অর্জন তাকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না এবং অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতি মাসে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ভিত্তিক কাজের অগ্রগতি জাতির সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। নিজ নিজ সম্পদের হিসাব দেওয়ার ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন, এনআইডি কার্ড স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করার আইন অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বাতিল এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের ভুয়া ভোটে নির্বাচিত সব ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল, নির্বাচন সংস্কার কমিশনে জেসমিন তুলিসহ দু-একজন বিতর্কিত বা ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগীদের নিয়োগ বাতিল এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কালো আইন বাতিল করতে হবে।
২০০৭ সালে থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সব মিথ্যা ও গায়েবি মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, আইন ও স্বাস্থ্যসহ যেসব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়, সেখানে দায়িত্ব রদবদল বা নতুন উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে কার্যকর গতিশীল করতে হবে এবং প্রয়োজনে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সহকারী উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। অবিলম্বে গণতদন্ত কমিশন গঠন করে জুলাই-আগস্টে সংগঠিত সব নৃশংসতার ঘটনা জাতির সামনে তুলে ধরা এবং প্রতিটি শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন এবং আহত ও পঙ্গু ছাত্র-জনতার চিকিৎসা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সিভিল প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিপাহিদের মধ্যে যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের কমিশনের মাধ্যমে চাকরিতে সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগী ব্যক্তি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের বিচারের জন্য ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর পাশাপাশি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের ছয়টি কমিশনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে একটি জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন এবং সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীর সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্যও পৃথক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ফ্যাসিবাদী সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব দেশবিরোধী চুক্তি করেছে তা পর্যালোচনা করে অসম চুক্তি বাতিল করতে হবে এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে যারা অবৈধ টাকার পাহাড় গড়েছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করেছে তাদের সম্পত্তি জব্দসহ দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। জামায়াতকে আবার জোটে আনতে চান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা ২০-দলীয় জোটের বাইরে। আমরা প্রায় ৪২টি রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলন করেছি। এই আন্দোলনে জামায়াত কখনো ছিল, কখনো ছিল না। তিনি বলেন, জামায়াত ’৮৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে গিয়েছে কিন্তু সেটা জনগণ মেনে নেয়নি। ’৯৬ সালে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করেছে। এই আলাদাভাবে নির্বাচন করে বিএনপি এবং জামায়াত উভয় দলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দেশে ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েম হয়েছে। না হলে ’৯৬ সালে এই দেশে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব থাকত না। জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে আমরা যেন আগামীতেও একসঙ্গে পথ চলতে পারি। ১২-দলীয় জোটের পক্ষ থেকে এটা আহ্বান থাকবে জামায়াতের প্রতি। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহ সভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টি একাংশের চেয়ারম্যান ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজসহ জোটের শীর্ষ নেতারা।