শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
আবুল হুসেন

চেতনা বিনির্মাণের কারিগর

তুহিন ওয়াদুদ

চেতনা বিনির্মাণের কারিগর

জম্ন : ৬ জানুয়ারি ১৮৯৭ মৃত্যু : ১৫ অক্টোবর ১৯৩৮

বাঙালির চিন্তা গঠনের বেশ কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। তার মধ্যে কোনো কোনো পর্যায়ের বিস্তৃত বিবরণ অনেক সময় জানা সম্ভব হয়নি। বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তনের পর বিহারে যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এসে পাঠ গ্রহণ করতেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা সে সময়ের গ্রন্থভিত্তিক কোনো জ্ঞানচর্চার প্রামাণ্য নিদর্শন আমাদের কাছে নেই। তবে পাল শাসনামলে রচিত বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সাধন সংগীত হলেও সেখানে বাঙালির জ্ঞানচর্চার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ভূখণ্ডে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে শুরু হয় ইসলাম ধর্মভিত্তিক জ্ঞানচর্চা। মূলত ঊনবিংশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলায় যে জ্ঞানচর্চা হয় তা ছিল ধর্মভিত্তিক। বাংলা ভাষায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর এবং বিশেষত বাংলা ভাষায় গদ্যরীতি প্রবর্তনের পর থেকে বাংলায় মননশীল চিন্তার স্ফ‚রণ ঘটে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশ ভাবাদর্শ। সনাতন-বৌদ্ধ-মুসলমানদের আধ্যাত্নিক একটি ধারা সমন্বিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক একটি ক্ষীণ স্রোত প্রবাহিত করেছিল। এ প্রবাহে মিশেছিল পাশ্চাত্য দর্শন। বাঙালি সমাজ তখন ক্রমেই কুসংস্কারের খোলসমুক্ত হতে থাকে। সমাজ সংস্কারকরা সমাজের প্রতিক‚লে সাহসী উচ্চারণ-প্রবণতা রপ্ত করতে থাকেন। সমাজ পরিবর্তনের বিশালায়তনে যে উদ্যোগগুলো অনুঘটকের কাজ করেছে তার মধ্যে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ সবিশেষ উলে­খযোগ্য। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করেনÑ আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহের হোসেন, আবদুল কাদির, আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ।   

বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব আবুল হুসেন (১৮৯৭-১৯৩৮)। তার জীবনখণ্ডে বাঙালি মুসলমান সমাজ ছিল শাস্ত্রের নিগড়বৃত্তের বেষ্টনীতে। শাস্ত্রবদ্ধ জীবনাচরণ বুদ্ধিকে করে রেখেছিল শৃঙ্খলিত। মুসলমানদের চিন্তার অবমুক্তি সাধনের চেষ্টায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। ‘শিখা’ ছিল তাদের মুখপত্র। কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, আবদুল কাদির, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আনোয়ারুল কাদির, আবুল হুসেন সবার চেতনা প্রজ্বলিত হয়েছিল ‘শিখা’র মধ্য দিয়ে। যতদিন আবুল হুসেন ‘শিখা’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ততদিন শিখা প্রকাশিত হয়েছে। শিখাগোষ্ঠীতে তিনি ‘কর্মযোগী’ অভিধা লাভ করেছিলেন। তিনি মাসিক ‘তরুণপত্র’, মাসিক ‘অভিযান’, মাসিক ‘জাগরণ’সহ অনেক পত্রিকায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি মুসলমানদের অবরুদ্ধ চিন্তার ধরন, চিন্তা শৃঙ্খলিত হওয়ার কার্যকারণ বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে তার রচনায় উপস্থাপন করেছেন। প্রথাগত ধারণা এবং প্রচলিত রীতিবিরুদ্ধ উচ্চারণের কারণে আবুল হুসেনের প্রতি সমকালীন মুসলিম সমাজ শুধু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি, তৎকালীন নবাবদের দ্বারা পঞ্চায়েতে তাকে দুবার সালিশের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ছিলেন তিনি। তার সমালোচকদের শক্ত জবাব দিতে তিনি সেই অধ্যাপনা ছেড়ে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবু মুসলমানদের মুক্তবুদ্ধির দীক্ষাদান থেকে বিরত থাকেননি। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম আইন বিষয়ে এমএল ডিগ্রি লাভ করেন।   

শিখাগোষ্ঠীর যারা লেখক ছিলেন তারা সমাজ পরিবর্তেনের সংগঠকও ছিলেন। শিখাগোষ্ঠীর লেখক-সংগঠকদের চিন্তা-চেতনার মধ্যে একটা ঐক্য ছিল। সেই ঐক্য বিশ্লেষণে তাদের এক রৈখিকতায় মূল্যায়ন করা যায়। যেমন মোতাহের হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতিবান মানুষের জন্য সাধনা করেছেন। তার সংস্কৃতিবান হওয়ার মূল অর্থ হচ্ছে সে চিন্তার স্বাধীনতা লাভ করা। নিজের মধ্যে একজন আল্লাহ তৈরি করে নেওয়া। প্রচলিত ধারণায় আল্লাহকে আকাশে কল্পনা করা হয়ে থাকে। তিনি তাদের থেকে সাবধান থাকার কথা বলেছেন। আবুল ফজলের দার্শনিকতা বিস্তার লাভ করেছে বুদ্ধির মুক্তিকে কেন্দ্র করে। আবুল হুসেনও সেই চিন্তার অভেদ অনুষঙ্গ।

আবুল হুসেন তার লেখনীর শুরুতেই যে ধর্মের অসারতা নিয়ে লিখেছেন তা নয়। মুসলমানদের পতিত অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রয়োজনে তিনি তার লেখনী শুরু করেন। যেমন ১৩৩২ সনের জ্যৈষ্ঠ মাসে লেখা ‘সত্য’ প্রবন্ধ, ১৩৩২ সনে লেখা ‘আজ্ঞানুবর্তিতা’ এবং ১৩৩৩ সনের আষাঢ় মাসে লেখা ‘আমাদের কর্তব্য’ প্রবন্ধ তিনটিতে ধর্মের আলোকে মুসলমানদের মুক্তির পথ সন্ধান করেছেন। এমনকি রসুলের বাণী দ্বারা শিক্ষার প্রতি, জ্ঞানের প্রতি মুসলিম বোধের উম্নীলন সাধনের চেষ্টা করেছেন। আজ্ঞানুবর্তিতা প্রবন্ধে অন্ধ বিশ্বাস পরিহার করার কথা বললেও ধর্মের গুরুত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ যে জ্ঞানের প্রচারক তা তাদের মৌলিক সৃষ্টি নয়। বুদ্ধির মুক্তির ধারণা প্রধানত ইউরোপীয়।  বিশ্বমানবতার জন্য বিশ্বজনীন জ্ঞান প্রয়োজন। সেই জ্ঞান ধর্ম চর্চার মধ্যে কতখানি বিরাজিত তার একটি মূল্যায়ন এবং সেই মূল্যায়ন সাপেক্ষে নিরাসক্ত বস্তুনিষ্ঠ কথা বলেছেন। সেই সত্য ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও তা বলা থেকে বিরত থাকেননি। মুসলমান সম্পর্কে তিনি কী করতে চান সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, মুসলমানকে এমন শিক্ষা দিতে হবে, সে যেন বলতে পারে, ‘আমি চাই না অর্থ, চাই না সাম্রাজ্য, আমি চাই সত্য, আমি দুর্বলতা ও দৈন্যকে দূর করতে জগতে এসেছি।’

‘মুসলিম কালচার ও উহার দার্শনিক ভিত্তি’ প্রবন্ধে আবুল হুসেন ইসলাম ধর্মকে মানবতার ধর্ম বলেই উলে­খ করেছেন। তবে ধর্মকে পরিবর্তনীয় করে তোলার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ইউরোপীয় রেনেসাঁস প্রসূত মানবতাবাদী ধারার গোড়াপত্তন ইসলাম ধর্মেই হয়েছে এমনটাই তিনি উলে­খ করেছেন। তার ভাষায় ‘যে জধঃরড়হধষরংস এর সন্ধান পেয়েছিল ইউরোপ অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইসলাম তা প্রচার করেছিল ঊষর মরুভূমির বুকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে, যার ফলে আরবরা ক্ষুদ্র গ্রাম্যতার গণ্ডি কেটে এক হয়ে প্রবল স্রোতের ন্যায় চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল আর ঘোষণা করেছিল : ‘সকল মানুষই এক জাতি, মানুষই এই দুনিয়ার প্রভু তারই জন্য এই জগৎ, সকল মানুষ এক স্রষ্টার বান্দা’ ইত্যাদি ...।’

আবুল হুসেন এ প্রবন্ধে ইসলাম ধর্মের নিরবচ্ছিন্ন স্তুতি করেননি। একদিকে তিনি বলছেন, ‘মুসলমান জগৎ বুদ্ধির ঘরে তালা লাগিয়ে কেবল শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মুসলমানের চলার পথে বিঘণ্ন ঘটাচ্ছে।’ আবার অন্যদিকে তিনি বলছেন ‘মুক্তবুদ্ধি প্রয়োজনবশত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন লাভ করে।’  

আবুল হুসেনের সাহিত্যিক জীবনের পরিব্যাপ্তি সাধিত হয়েছে মুসলিম সমাজের পতিত অবস্থা থেকে উত্তরণের সাধনায়। ‘আমাদের কর্তব্য’ প্রবন্ধে তিনি কয়েকটি প্রশ্নের অবতারণা করেছেন ‘আমরা কি শিক্ষা ক্ষেত্রে যাব শুধু চাকরির যোগ্যতা অর্জন করতে? আমাদের নেতারাও কি কেবল সেই যোগ্যতা দেখেই সন্তুষ্ট থাকবেন? আমরা কি বিশ্ব জগতের জ্ঞানের উৎসবে আমাদের বাতিটি জ্বালাব না?  সবাই ছুটে আসছেÑ জ্ঞান-বাতির দেয়ালী-উৎসবে নিজ নিজ বাতি নিয়ে। কিন্তু কই মুসলমানকে তো দেখছি না ?’

‘আমাদের কর্তব্য’ প্রবন্ধে তিনি যে প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, সেই সমাধান সন্ধান করতে গিয়ে তিনি মুসলমানদের ধর্মান্ধতা থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য একটি সরল পথের সন্ধান করেছেন। সেই পথনির্দেশনায় তিনি যে মতবাদ দাঁড় করেছেন তার মূূল বার্তা হচ্ছেÑ ধর্মের গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে জ্ঞানের মুক্তি অসম্ভব। ‘আমাদের কর্তব্য’ প্রবন্ধে ধর্মের প্রতি কোমল আঘাত পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে যেন কঠিন রূপে উচ্চারিত। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ মুখপত্র ‘শিখা’র আলোয় যে সত্যকে, যে বোধকে বিশ্ব মানবতার বলে উলে­খ করা হয়েছে, তা হলোÑ ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এ বাণীরই প্রতিধ্বনি তার চেতনা বিনির্মাণমূলক প্রবন্ধগুলো।

মুসলমানের সত্য প্রাপ্তির প্রতিক‚লতা নির্ণয় করে ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ প্রবন্ধটি লিখেছেন। নিষেধ প্রবর্তিত হয় সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার তাগিদে। আবুল হুসেন নিষেধ প্রক্রিয়ায় কোনো ফল হয় না বলে মত দিয়েছেন ‘সত্য বলতে, কোন শাস্ত্রকারের নিষেধের রাশি সমাজকে জন্তুধর্মী মানুষের প্রবৃত্তি অনাচার হতে কখনো মুক্ত করতে পারেনি।’ বরং তিনি নিষেধের নেতিবাচকতা দেখতে পান। শাস্ত্রের নিষেধাজ্ঞা সমাজে সংস্কার বয়ে আনে। সেই সংস্কার সেই সময়ের জন্য যতখানি প্রযোজ্য তা যে সব সময়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য নয় তা শাস্ত্রবাদীরা মানতে চান না। আবুল হুসেন মনে করেন শাস্ত্রের নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী সময়ের জন্য অনেকখানি অপ্রযোজ্য হওয়া সত্তে¡ও শাস্ত্রবাদীরা আর তা স্বীকার করেন না।

এ প্রসঙ্গে তিনি ধর্মের মধ্যে থেকে ধর্মকে অস্বীকার করার যে কথা তিনি বলেছেন তাতে কিছুটা স্ববিরোধিতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ধর্মকে অসার হিসেবে চিহ্নিত করে। ইসলাম ধর্মকে হাজার বছরের পুরনো আখ্যা দিয়েছেন। চোখে যে ১০০০ বছরের পুরনো ধর্মের ঠুলি লাগান আছে, সেটা খুলে ফেলে, খোদার দেওয়া চক্ষু দিয়ে দুনিয়াটাকে একবার ভালো করে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন।     

বোধের ঋদ্ধি আনয়নের চেষ্টায় রত ছিলেন প্রবাদপ্রতিম কারিগর আবুল হুসেন। প্রথাগত চিন্তার অসারতার বিরুদ্ধ স্রোতে অনড় থেকেছেন সব সময়। মাত্র ৪১ বছরের জীবনে তিনি যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তা বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে। তার ‘সত্য’, ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’, ‘মুসলিম কালচার ও উহার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘অতীতের মোহ’, ‘তরুণের সাধনা’, ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধগুলো মানুষের যুক্তিবাদী চেতনা বিনির্মাণে এখনো অপরিহার্য।   

সর্বশেষ খবর