দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিজাত ও শিল্পজাত পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ ও সাশ্রয়ী করার নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। একই সঙ্গে শিল্পজাত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা সম্প্রসারণের জন্য প্রথমবারের মতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১২৫টি লাগেজ ভ্যানও যুক্ত করা হচ্ছে এই পরিবহনে।
মূলত কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে যাত্রীখাতে আয় বাড়ানো এবং নানাবিধ পরিকল্পনাসহ বিভাগীয় বাণিজ্য বিভাগের কিছু প্রস্তাবনা তৈরির কাজও চলছে। তবে বিভিন্ন বিশেষায়িত কৃষি ও শিল্প পণ্য উৎপাদনকারী অঞ্চলের কথা মাথায় রেখে গুডস ও কৃষিজাত পণ্য পরিবহনের জন্য রেলওয়ের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগ নতুন ট্রেনসূচি তৈরির কাজ শুরু করেছেন বলে জানান রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলওয়েকে আরো আধুনিকায়ন করতে নানাবিধ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে প্রতিটি ট্রেনেই নতুন নতুন কোচও লাগানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, রেলওয়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিজাত পণ্য সহজ ও সাশ্রয়ীভাবে পরিবহন করতে রেল প্রশাসন প্রস্তুত। এতে যাত্রীসেবার পাশাপাশি পণ্য পরিবহনও করতে নতুন নতুন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, রেলের কাছে যেসব লাগেজ ভ্যান রয়েছে সেগুলো খুবই পুরনো। তাছাড়া নানান কারণে রেলপথে কৃষিপণ্য পরিবহনে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।
সারাদেশে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও কৃষকদের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যান থাকায় দেশের কৃষিপণ্য পরিবহনে রেলওয়ে কর্মপরিধি আরও বাড়বে বলে জানান তিনি।
পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্য কর্মকর্তা (সিসিএম) মো. নাজমুল হোসেন বলেন, কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য নতুন উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন কর্ম-পরিকল্পনার বিষয়ে একাধিকবার বৈঠকও করা হয়েছে। রেলওয়ের পরিবহনের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আরো নতুন নতুন কর্ম-পরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে। তবে মূলত দেশের প্রধান প্রধান কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পাঞ্চলকে কেন্দ্র করে রেলের লাগেজ ভ্যান ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার দপ্তর থেকে একটি ১৭ দফা প্রস্তাব তৈরির কাজ চলছে। এসব প্রস্তাবনাগুলো পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আলোচনা করেই রেলভবনে পাঠানো হবে।
পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপককে দেওয়া এই প্রস্তাবনায় রয়েছে রেলওয়ের বহরে ৭৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান যুক্ত হচ্ছে। এই লাগেজ ভ্যানগুলো সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে রেলওয়ের রাজস্ব আয় বাড়বে। রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা আরও সহজ করতে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে লাগেজ ভ্যান সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবও দেয়া হয়। কোন ট্রেনে কয়টি করে লাগেজ ভ্যান বৃদ্ধি করতে হবে তার একটি তালিকাও দেওয়া হয়।
১৭টি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিন বিভিন্ন রুটের ট্রেনে লাগেজ ভ্যান চলাচল না করায় ব্যবসায়ীরা অন্য মাধ্যমে পণ্য পরিবহন, ব্যবসায়ীদের রেলমুখী করার জন্য পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা, প্রতি মাসে অন্তত দুইবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদর সঙ্গে স্টেশন মাস্টারের মতবিনিময় সভা করা, নির্দিষ্ট স্টেশনে মালামাল পরিবহনের জন্য আলাদা আলাদা লাগেজ ভ্যান সংযোজন ও সংরক্ষণ করা, স্টেশনে লাগেজ বা পার্সেল মালামাল পরিবহনের জন্য ওজন যন্ত্র এবং লম্বা লরী ও ভ্যান সরবরাহ, দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও শিল্প গ্রুপের সঙ্গে মালামাল পরিবহনে রেলওয়ে চুক্তি সম্পাদন করা, সর্বোচ্চ মালামাল পরিবহনকারী ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা এবং স্টেশনকে পুরস্কার দেয়া, আগের মতো আন্তঃনগর ট্রেনেও পরীক্ষামূলকভাবে একটি করে লাগেজ ভ্যান সংযোজন করা, যাত্রীবাহী ট্রেনে নতুন করে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করার পর পরিকল্পনাটি জনপ্রিয় হলে পর্যায়ক্রমে যাত্রীবাহী ট্রেনে লাগেজ ভ্যানের সংখ্যা বাড়ানো।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে ৫০টি ব্রডগেজ ও ৭৫টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান সংগ্রহের জন্য চুক্তি হয়েছে। চীন থেকে ক্রয়ের জন্য প্রক্রিয়াধীন এসব লাগেজ ভ্যান আগামী দুই বছরের মধ্যে রেলের বহরে পর্যায়ক্রমে যুক্ত হবে। এর মধ্যে ৫৯টি মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান, ৩৮টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান, ১৬টি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত মিটারগেজ লাগেজ ভ্যান এবং ১২টি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত লাগেজ ভ্যান যুক্ত হলে সারা দেশের দ্রুত পঁচনশীল কৃষিপণ্য (দুধ, মাছ, দুগ্ধজাতীয় পণ্য) পরিবহন সহজতর হবে। এসব লাগেজ ভ্যানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ী সমিতির সাথে আলোচনা করছে রেলওয়ে।
রেলের রোলিং স্টক বিভাগের তথ্যমতে, ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫১ অনুযায়ী রেলওয়ের লাগেজ ভ্যান ছিল ১২০টি। কিন্তু দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় বর্তমানে ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫২ এ লাগেজ ভ্যানের সংখ্যা কমে ১০০টিতে নেমে এসেছে। নতুন পরিকল্পনায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান আমদানি হলে রেলের কৃষিপণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় দ্বিগুণের বেশি সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন রেলওয়ের পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগ।
বিডি প্রতিদিন/এমআই