১৫ নভেম্বর, ২০১৯ ২২:০৩
‘সার্চিং দেবেন টাকা দেবেন, নকল নেবেন টাকা দেবেন’

বরিশালে সেরেস্তা সহকারীর ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল

বরিশালে সেরেস্তা সহকারীর ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল

ভাইরাল হওয়া ভিডিও থেকে স্ক্রীনশট নেওয়া ছবি।

বরিশাল বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সেরেস্তা সহকারী রেখা রানী দাসের ঘুষ দাবি করা ও নেওয়ার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে ভিডিও ক্লিপটি কবে ধারনা করা হয়েছে তা জানা না গেলেও শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে আকাশ বাংলা নামে একটি ওয়েবসাইটে শেয়ার করা হয়।

এরপর ৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিও চিত্র ফেসবুকে শেয়ার করে নানা মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন অনেকে। তারা এই ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনার দাবি তুলেছেন। 

ঝালকাঠীর নলছিটির বাসিন্দা মনির হোসেন জানান, সম্প্রতি তিনি একটি মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে জামিন আদেশের (বেলবন্ড) নকল কপি তোলার জন্য নিয়মানুযায়ী কোর্ট ফিসহ আবেদন করেন। গত সপ্তাহে তিনি সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে নকল জামিন আদেশ পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলে সেরেস্তা সহকারী রেখা রানী দাস তার কাছে এক হাজার টাকা দাবি করেন। 

ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রেখা তাকে বলেন ‘সার্চিং দেবেন টাকা দেবেন, নকল নেবেন টাকা দেবেন’। ওই ব্যক্তি বলেন, টাকার নেওয়ার কোন রিসিট (মেমো) দেবেন। রেখা বলেন, জজকোর্টে কোন মানি রিসিট হয় না। ওই ব্যক্তি বলেন এটা কেমন কথা বললেন, এহন টাকা ছাড়া আপনি নকল দেবে না। রেখা বলেন, মহুরী লইয়াআন, উকিল মহুরীগো ধারে যাইয়া জিগাইয়া আন, টাহা লাগে কিনা। 

ওই ব্যক্তি নিজে আবেদন করেছেন জানিয়ে ফের নকল দাবি করলে রেখা বলেন, এহানে বইয়া চিল্লাইবেন না। রেখা আবেদনের কপিটি বের করে বলেন, দ্যাহের এই আবেদন করছে আপনার মোহরী হ্যারে লাইয়াআন। ওই ব্যক্তি বলেন, মোহরী আবেদন করে নাই, তিনি নিজেই আবেদনকারী, জামিননানা না পেলে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করবে। এ সময় রেখার টেবিলের সামনে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, একটা ছাড় দেন ম্যাডাম, একটা ছাড় দেন। 

রেখা বলেন, কিসের ছাড় দিমু, আপনি মহুরী লইয়াআন, সার্চিং পায় মহুরী, আসামি সার্চিং পাইবে না। ওই ব্যক্তি বলেন, আবেদনের কোন কলামে লেখা নাই উকিল-মহুরী ছাড়া সার্চিং পাইবে না। রেখা বলেন, মহুরী লাইয়াআন, কাড নম্বর (মহুরী নম্বর) ছাড়া কাউরে সার্চিং দেই না। এ পর্যায়ে ওই ব্যক্তি বলেন, তয় এক হাজার টাহা দেলে পামু। এবার রেখা বলেন, আপনার মহুরী লইয়াআন, মহুরী সই কইর‌্যা নেবে। 

এ পর্যায়ে সামনে থাকা এক ব্যক্তি আবারও ওই ব্যক্তির নকল কপি দিয়ে দেওয়ার জন্য রেখার প্রতি অনুরোধ করেন। তখন রেখা নকল আবেদনকারীকে উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার লাগে কোন কথা নাই, উকিল মহুরী লাইয়াআন। 

এ সময় আরেক মহুরী আসে রেখার টেবিলের পাশে। তাকে দেখিয়ে রেখা বলেন, আসামি কি সার্চিং পাইবে ? ওই মহুরী হ্যা সূচক মন্তব্য বলার পর রেখা আবারও ওই ব্যক্তিকে বলেন মহুরী ছাড়া দেই না। কার্ড নম্বর ছাড়া দেই না। 

এ পর্যায়ে ওই মহুরী তার মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চান। তখন রেখা তাকে বলেন, তার মামলার ফাইলটি স্যারের কাছে (কোর্টে উপস্থাপন) ধরছিলাম। স্যারেরে কইছি, স্যার প্রথম পক্ষ আয় নাই, দুই দিন যাউক খারিজ কইর‌্যা দিমু। যেহেতু আপনারা কেউ কিছু দেন টেন নাই, স্যারেরে কইছি, স্যার আবেদন দিয়া থুইয়া গ্যাছে, কেউ যোগাযোগ করে নাই। ৩ দিন হইলে খারিজ কইর‌্যা দিমু। এ পর্যায়ে ওই ব্যক্তি মহুরীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, দ্যাহেন ভাই, এই আবেদনটা আমি কি নকল কপি পামুনা। এ সময় ওই মহুরী তার মামলা বাবদ রেখা রানীকে ১শ’ টাকার ৩টি নোট দেন। কিন্তু রেখা তাতে সন্তুস্ট না হয়ে বলেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তার ২শ’, কর্তার ১শ’, হ্যারপর পিওন-টিওন রইছে না। এ কথা বলার পর ওই মহুরী একশ’ টাকার আরও একটি নোট দিয়ে যান রেখাকে। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, আপনি (রেখা) ওনার কাছ থেকে কিসের টাকা নেন কিসের টাকা নেন। কিন্তু রেখা কোন জবাব দেয়নি। ওই ব্যক্তি মহুরীকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কিসের টাকা দিলেন। মহুরী বলেন, আমি একটা নকলের জন্য ৪শ’ টাকা দিয়া গ্যালাম। রেখা তখন তার আবেদনটা ওই ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলেন, দ্যাহেন, হে আবেদন করছে না। আপনি উকিল-মহুরী লাইয়াআন, আপনের লগে কোন কথা নাই। তখন ওই ব্যক্তি বলেন, এখন উকিল-মহুরী পাডাইলেও কি টাকা লাগবে। রেখা জবাবে বলেন, ‘হ’। আগে উকিল-মহুরীগো লগে কথা কমু, হ্যারা যা দেই হেইয়াই নিমু। 

ওই ব্যক্তি এ পর্যায়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে রেখাকে বলেন, আপা কোর্ট ফি লাগাইয়া সরকাররে রাজস্ব দিয়া আবেদন করছি, এখন আমি কি নকল পামু না। আমি কোন ঘুষ দিমুনা। জবাবে রেখা বলেন, আপনার ঘুষ দেওয়ার দরকার নাই। 

ওই ব্যক্তি আরও রাগন্বি হয়ে এবার রেখার পুরো নাম এবং পদবী জানতে চান। রেখা তাকে বলেন, আপনার সাথে কোন কথা নাই। আপনি উকিল-মহুরী লাইয়াআন, হ্যারা যদি কয়, তাহলে ফ্রি দিমু। 

ওই ব্যক্তি বলেন, আপনি মহিলা মানুষ, মায়ের জাতী, আপনি তো এভাবে করতে পারেন না। তখন রেখা বলেন, সকালে স্যারেরে দিয়া অর্ডার করাইডাই আমার ভুল হইছে। তারিখের দিন আইতেন, তারিখের দিন করতেন হেইডাই ভালো হইতো। 

ওই ব্যক্তি তখন বলেন, নকল পাইলে থানায় নিয়া জমা দিতাম পুলিশ আমারে ধরতো না। কিন্তু এখন যদি পুলিশ আমারে ধরে তার সকল লায়াবেলিটি আপনার; এ বলে চলে যান তিনি। 

ট্রাইব্যুনালের সেরেস্তা সহকারী রেখা রানী দাস বলেন, নকলের জমা খরচ আছে। কত পাতা, কত ফলি, কয় টাকার কোর্ট ফি, সব কিছুর সিল আছে। ফটোকপি করতে টাকা লাগে। ওই টাকা চাওয়া হয়েছে। ভিডিওতে আরেক মহুরীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সত্যতাও স্বীকার করেন তিনি। ঘটনাটি গত সপ্তাহের বলে রেখা স্বীকার করেন। 

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে সদ্য যোগদানকারী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এএইচএম মাহমুদুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ওই ট্রাইব্যুনালের পেশকার মুরাদ হোসেন বলেন, ওই ভিডিও’র কথা তিনি শুনেছেন, দেখেননি। 

বরিশাল জেলা জজ আদালত আদালতের আইন কর্মকর্তা (পাবলিক প্রসিকিউটর) অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, আমি ওই ভিডিওটা দেখেছি। এটা শোভনীয় নয়। সব সেরেস্তাই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোনোটা প্রকাশ্যে আসছে, কোনোটা আসে না। পয়সা ছাড়া কোন সেরেস্তায় কাজ হয় না। এ থেকে মুক্তি চাই। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেখা রানী দাস বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে অফিস সহায়ক (পিওন) পদে চাকরিতে যোগ দেন। পরে দুই দফায় পদোন্নতী পেয়ে পর্যায়ক্রমে প্রসেস সার্ভার ও সেরেস্তা সহকারী হন তিনি। 

ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওটি-

 


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর