মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকিতে সমপ্রতি প্রায়ই দেখা মিলছে মেছোবাঘের। বিড়ালের মত দেখতে এই প্রাণীটি আকারে যত ছোটই হোক না আচরণগত বৈশিষ্ট্যে প্রাণীটি বিশালাকৃতির বাঘের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়! এমনটাই তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে। হাওরপাড়ের ভুকশিমইল গ্রামের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান মিন্টু, শেখ কামিল আহমদ, নজরুল ইসলাম জানালেন, হাকালুকি হাওরের চৌকিয়া, নাগুয়া, তোড়ল, কাঠুয়া, গৌড়কৌড়ি, হাওরখাল, লামা-নাগুয়া, পিংলা, বালিকুঁড়ি, জল্লা, পট্টি, উদখাইসহ বিভিন্ন বিলের চরে এখন এই অদ্ভুত সুন্দর প্রাণীটির বিচরণ লক্ষ্যণীয়। হিজল-করচের অনিন্দ্য সুন্দর বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটলেই দেখা মিলে মেছোবাঘের।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমপ্রতি অনুকূল পরিবেশের কারণেই হাকালুকিতে এখন দেখা মিলছে ওদের। হাকালুকি হাওরপাড়ের ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও হাওর বাঁচাও-কৃষক বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি সিরাজ উদ্দিন আহমদ বাদশা জানান, এ হাওরে মেছোবাঘের আগমন নতুন নয়। অনেক আগে থেকেই শুকনো মেৌসুমে এখানে মেছোবাঘের (স্থানীয়দের ভাষায় খুফিয়া বাঘ) উপস্থিতি ছিল। ১৯৪৮ সালের আগে হাকালুকি হাওরের সব এলাকাজুড়ে ছিল হিজল-করচের বন আর সেখানে ছিল বাঘ, হরিণ, শুকর, শিয়াল, বেজিসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী আর বিভিন্ন প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ-প্রাণী। তখন হাকালুকি হাওর বনবিভাগের আওতাধীন ছিল, যা পরে জেলা প্রশাসনের খাস জায়গার তালিকায় চলে যায়। পাকিস্তান শাসন আমলে হাওরের জঙ্গল দিন দিন কমতে থাকে এবং ১৯৭১ সালের পর সেই বন পুরোটা শেষ হয়ে যায়। তখন সেখানে কোনো বন্যপ্রাণী দেখা যেত না, মাছ কম পাওয়া যেত, পাখি শিকারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় পাখির সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকে। ছড়ার পাড়ে গাছপালা কমে যাওয়ায় উজানের পলি এসে হাওর ভরাট হতে থাকে, হাওরবাসীর ক্ষেত-খামার অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক কথায় হাকালুকি হাওরের পরিবেশ ভারসাম্য হারায়। পতিত হয় সংকটাপন্ন অবস্থায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, হাকালুকি হাওর পরিবেশ ব্যবস্থার এ সংকটাপন্ন অবস্থা নিরসন প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার হাকালুকি হাওরসহ দেশের অন্যান্য হাওরকেও পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। পরে সেখানকার জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে পরিবেশ অধিদফতরের আওতায় গ্রহণ করা হয় কয়েকটি প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলো ২০০৪ সাল থেকে অদ্যাবধি হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওরের ধ্বংসপ্রাপ্ত হিজল-করচ বন সংরক্ষণের পর সেখানে আজ প্রায় এক হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হিজল-করচের বন। আর তাতে এখন শুকনো মৌসুমে শুধু মেছোবাঘই নয়, সেখানে আশ্রয় নেয় পাতি শিয়াল, সাপ, বেজিসহ অন্যান্য প্রজাতির বন্যপ্রাণীও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এখন প্রতিরাতেই মেছোবাঘের ডাক শোনা যায়। তাদের ডাকে সাধারণত রাতের বেলা এ অঞ্চলের শিশু-কিশোরদের মনে যদিও ভীতির সঞ্চার হচ্ছে তবু এ প্রাণীটির প্রত্যাবর্তনে তারা যথেষ্ট খুশি।
বিডি-প্রতিদিন/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শরীফ