ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে টানা ১০ বছরের বেশি সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন নসরুল হামিদ বিপু। এ সময়ে সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়কে পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিলেন। ১০ বছর ধরে রীতিমতো লুটের উৎসব করেছেন। তাঁর দুর্নীতির কাহিনি আরব্য রজনির রূপকথাকেও হার মানায়। শুধু বিপু একা নন, ভাই, স্ত্রী, ছেলে, মামা সবাই লুটেছেন বিদ্যুৎ খাতের বিপুল পরিমাণ অর্থ। ১০ বছরে বিপুর লুণ্ঠনের পরিমাণ ১ লাখ কোটির বেশি টাকা, যা দেশের এক বছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। তাঁর রাজত্বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে টাকাই ছিল শেষ কথা। নিজেই কোম্পানি খুলে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। গড়েছেন দুর্নীতির পারিবারিক সিন্ডিকেট। এ রকম একটি দুর্নীতির রোমহর্ষক কাহিনি হলো মাতারবাড়ী প্রকল্প। জাপানের মারুবেনি করপোরেশন, ডাচ্-সুইস জ্বালানি কোম্পানি ভিটল এবং পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি কোম্পানির যৌথ ব্যবসায়িক জোট বা কনসোর্টিয়ামকে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে দেশের বৃহত্তম এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বিপু। এ কনসোর্টিয়াম আসলে ছিল বিপুর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু মাত্র ১০০ ডলার পরিশোধিত মূলধনের একটি কোম্পানি-পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল-কীভাবে ৩০৫ মিলিয়ন ডলারের কাজ পাওয়া একটি কনসোর্টিয়ামের অংশ হতে পারে? অনুসন্ধানে দৃশ্যপটে আসেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু স্বয়ং। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশে নিবন্ধিত। নথিপত্র ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল নামে এ কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রক স্বয়ং নসরুল হামিদ বিপুর আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। প্রতিমন্ত্রীর পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হামিদ গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাহীরাই পাওয়ারকোর হর্তাকর্তা। একসময় নসরুল হামিদ নিজেই হামিদ গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পারিবারিক এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে একাধিক ব্যবসা পরিচালনা করে। এর কয়েকটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও ছিলেন বিপু। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ শেয়ারের মালিক তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের ব্যবসা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর প্রধান শেয়ারধারী হলেন কামরুজ্জামান চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। তাঁর পরিচয়সংক্রান্ত নথিপত্র ও সমাজমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কামরুজ্জামান চৌধুরী হলেন নসরুল হামিদ বিপুর আপন মামা। কামরুজ্জামান চৌধুরী নিজেও দীর্ঘদিন ধরে হামিদ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর ছেলে, ভাই ও ভাইয়ের ছেলেরা হামিদ গ্রুপের শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন ও করছেন।
সিঙ্গাপুরে দাখিলকৃত নথিপত্র অনুযায়ী পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের একজন বিকল্প পরিচালক হলেন মুরাদ হাসান। পাশাপাশি তিনি কোম্পানিটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা বা সিও হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী, পাওয়ারকোর সিও হিসেবে তিনি বিপিসির সঙ্গে সরাসরি মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনাল প্রকল্পের দরকষাকষিতে অংশ নিয়েছিলেন।
এই মুরাদ হাসানই আবার ‘ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট’ নামে হামিদ গ্রুপের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও ছিলেন। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় নসরুল হামিদ হলফনামায় জানান, তিনি নিজেই ডেলকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সে সময় তিনি কোম্পানিটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারেরও মালিক ছিলেন। বর্তমানে ডেলকোর মালিকানা তাঁর ছেলে জারিফ হামিদ ও ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদের হাতে। শুধু মুরাদ হাসানেই সীমাবদ্ধ নয় ডেলকো ও পাওয়ারকোর সম্পর্ক। অঘোষিত ও গোপন এ সম্পর্কের সূত্র খুঁজে দেখা যায় বারিধারার ৩২ প্রগতি সরণিতে। পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল প্রথম নিবন্ধিত হয়েছিল এ ঠিকানায়।
এ ঠিকানায় কেইমরিচ, সুনন ও ইউরো নামে তিনটি অফিস ফার্নিচার ব্র্যান্ডের শোরুম রয়েছে। বাংলাদেশে এ বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর পরিবেশক হলো ডেলকো। ডেলকোর ওয়েবসাইটেও তাদের শোরুমের ঠিকানা : ৩২ প্রগতি সরণি, বারিধারা। আবার সুনন বাংলাদেশ বা sunon-bd.com ডোমেইনটির রেজিস্ট্রেশন রেকর্ড অনুযায়ী, এ ঠিকানাতেই ইন্তেখাবুল হামিদের নামে নিবন্ধিত হয়েছে ডোমেইনটি। অর্থাৎ ডেলকোর শোরুমের ঠিকানাতেই নিবন্ধিত হয়েছিল পাওয়ারকো।
বিপুর ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু নিজেও হামিদ গ্রুপের একাধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ইন্তেখাবুল হামিদের সঙ্গে পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাবিল খানের সংযোগ রয়েছে। এই ভারতীয় নাগরিক দুবাইভিত্তিক একটি বিনিয়োগপ্রতিষ্ঠান ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি শিপিংলাইনের মধ্যপ্রাচ্য শাখা পরিচালনা করেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাওয়ারকোর সঙ্গে জড়িত আরেক ব্যক্তি হলেন কোম্পানিটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক তারেক খলিল উল্লাহ, যিনি দীর্ঘদিন হামিদ গ্রুপে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইন্তেখাবুল হামিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, হামিদ গ্রুপের আরও দুজন কর্মকর্তা পাওয়ারকো গঠনের সময় আরজেএসসি অফিসে উপস্থিত ছিলেন। কোম্পানি হিসেবে পাওয়ারকোর নিবন্ধনের সময় এ দুজনকে সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়। জাহাঙ্গির আলম নামে একজন সাক্ষীর পরিচয়পত্র ও লিংক্ডইন প্রোফাইল দেখে জানা যায়, তিনি হামিদ গ্রুপের একজন সহকারী ব্যবস্থাপক। শেষ পর্যন্ত মাতারবাড়ীর কাজ না পেলেও নসরুল হামিদ বিপুর মন্ত্রণালয় থেকে কয়েক শ মিলিয়ন ডলারের কাজ পায় মারুবেনি ভিটল, পাওয়ারকো এবং ডেলকো। কোনো দরপত্র ছাড়াই এলএনজি সরবরাহের কাজটি তিন দফায় পেয়েছিল ডাচ্-সুইস জ্বালানি কোম্পানি ভিটল। আবার এ ভিটলের সঙ্গেই যৌথভাবে মাতারবাড়ী এলপিজি টার্মিনালের ৩০% মালিকানা পায় পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেট্রোবাংলার কাছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি সরবরাহের তিনটি কাজ ভিটল পেয়েছে পাওয়ারকোর সঙ্গে তাদের কনসোর্টিয়ামটি গঠিত হওয়ার পর। কনসোর্টিয়াম গঠনের পর বিপুর মন্ত্রণালয় থেকে কাজ পেয়েছে আরেক সদস্য মারুবেনিও। ২০২১ সালের মে মাসে মারুবেনি ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইজিসিবি) সঙ্গে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ইজিসিবিও নসরুল হামিদ বিপুর নিয়ন্ত্রণাধীন। ভিটল ও মারুবেনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বিতর্কে জর্জরিত। ২০১২ ও ২০১৪ সালে নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সরকারি প্রকল্পের কাজ পেতে ঘুষ প্রদানের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে শতাধিক মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে বাধ্য হয় মারুবেনি। এরই সূত্র ধরে নয় মাসের জন্য তাদের অর্থায়নে হওয়া প্রকল্পে মারুবেনির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিল জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা।
অন্যদিকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ভিটলের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ব্রাজিল, ইকুয়েডর ও মেক্সিকোয় ঘুষ প্রদানের দায়ে মার্কিন বিচার বিভাগের সঙ্গে শর্ত সাপেক্ষে প্রসিকিউশন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার একটি চুক্তি করে; যার অংশ হিসেবে ১৬৪ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেয় ভিটল।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু ও সাবেক সেতুমন্ত্রীর ভাতিজা মিলে অন্তত চারটি কোম্পানির মাধ্যমে পাঁচ বছরে বাগিয়ে নিয়েছেন ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) থেকে অ্যাডভান্স মিটারিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামের দুটি প্রকল্প বাগিয়ে নেয়। এ দুটি প্রকল্পের অর্থমূল্য ছিল ২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে একই কোম্পানি মোবাইল অ্যাপস অ্যান্ড কাস্টমার পোর্টাল প্রতিষ্ঠার নামে ডিপিডিসির থেকে বাগিয়ে নেয় আরও একটি মেগা প্রকল্প। এ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৫০০ কোটি টাকা। নসরুল হামিদের ভাই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক ও সিকিউরিটি নামে আটটি মেগা প্রকল্প হাতিয়ে নেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১ জুন বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) থেকে বাগিয়ে নেন ৫০ লাখ মিটার স্থাপনের কাজ। এ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ছিল ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সাধারণত একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি ধাপে তৎকালীন সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হতো। গত দুই বছরে ২৭টি সোলারভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পান দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এভাবেই বিগত ১০ বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছিল বিপুর পারিবারিক সম্পত্তি।