জুলাই আমার জীবনে এখনো জ্বলজ্বলে। বিশেষত একটা স্মৃতি আমাকে ভীষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখের সামনে দেখলাম আর্মি গুলি চালাচ্ছে। নিজের দেশের মানুষের দিকে। তাও আবার গলির ভিতরে তাক করে, ধুম করেই আমার ৫ ফুট দূরে এক ছেলের পায়ে লেগে গেল।
শাহজাদপুরের সেই বীভৎস স্মৃতি! শরীর কেঁপে উঠেছিল, বুক হিম হয়ে গিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এই কি সেই সেনাবাহিনী, যাদের রক্ষক ভেবে বড় হয়েছিলাম? সেই গুলির শব্দ আজও কানে বাজে। জুলাই আমাকে পাল্টে দিয়েছে। আমি বুঝেছি, চুপ করে থাকা মানেই অপরাধের অংশীদার হওয়া। তাই চুপ করে থাকা আর হয়নি।
জুলাইয়ে আমি এপ্রোন পরে পরে রাস্তায় ঘুরতাম, আন্দোলনে মানুষের মাঝে নানাভাবে মেশার চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে রামপুরা-বাড্ডা এলাকায়। একবার আওয়ামী লীগের টোকাই বাহিনীর সামনে পরে গিয়েছিলাম। ওই দিন ছিল ২২ তারিখ। আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সে ছিলাম। আমার সামনে কোকের ছোট বোতলে অকটেন ধরে বলছিল, আপনি ডাক্তার সেটা বুঝছি, কিন্তু আপনারাই ঘুরে ঘুরে আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা দেন। বাসায় যান, না হলে এটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেব। নানা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে ওই দিন রক্ষা পেয়েছিলাম। হাজার হাজার লাশের বন্যায় ভেসে যাওয়া জুলাইয়ের নৃশংসতা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। হাসিনার বিরুদ্ধে আমি সব সময়ই অনলাইনে সরব ছিলাম, সেই শাপলা গণহত্যা, মোদিবিরোধী আন্দোলন, ডামি ইলেকশন এসব ব্যাপারে সব সময়ই সরব ছিলাম। তবে হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে নামার প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন আন্দোলন। আমি আজীবন দেশে থাকার স্বপ্ন দেখেছি। বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারি না আমি বিদেশ গিয়ে থাকব। এজন্যই বাচ্চাদের ইংলিশ মিডিয়ামে দিইনি। কিন্তু যখন দেখলাম কারিকুলাম পরিবর্তন করে দেশের শিশুদের মেধা নষ্টের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে তখন আর চুপ থাকতে পারিনি। আমি তখন শুধু একজন চিকিৎসক ছিলাম না, ছিলাম একজন মা, আর একজন মায়ের সন্তান খুনের প্রত্যক্ষদর্শী। জুলাইয়ের তিন/চারমাস পরেও রাতে ঘুমাতে পারতাম না।
’৭১-এর পর ৫৩ বছর পার হয়ে গেল আমাদের সন্তানদের এমন একটা সমাজ দিয়ে যেতে পারিনি যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায়। জুলাইয়ের সেই দিনে আমি ডাক্তার হয়েও নিরুপায় ছিলাম। কোথাও চিকিৎসা দিতে গেলে ভয়ে থাকতাম- কখন যেন আমাকেও তুলে নিয়ে যায়। কারণ সাইবার ক্রাইমে থাকা সেই সময়ের সেলেব্রিটি পুলিশ আমাকে দুবার ফোন করছিল ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। সাবধান করেছিল। তখন আমি আজিমপুর ম্যাটারনিটিতে কর্তব্যরত ছিলাম। অনেক মায়েদের তখন ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিতে গিয়েছি। নিজের আইডিতে ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিলাম যেন কারও পেইন উঠলে হাসপাতালে কাউকে না পেলে আমাকে ফোন দেয়। তবে হাসপাতাল যেতে আসতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। হাসপাতাল থেকে মিথ্যা বলেও আন্দোলনে বের হয়েছি।
এক দিন হাসপাতালে ওটি করার সময় প্রচুর গুলির শব্দে আঁতকে উঠি। সেদিন ছাত্রদের গেটের মধ্যে পালাতে সাহায্য করেছে বলে পাশের কলোনির গেটম্যানকে গুলি করেছে। সঙ্গে একজন ব্যাংকারকেও। সেদিন রাতভর সেখানে নেগেটিভ রক্ত চেয়ে মাইকিং হয়েছে। সকালে বাসায় ফেরার সময় শুনি রক্ত না পেয়ে গুলিবিদ্ধ লোকটা মারা গেছে। আমি এই কথা বলছি আর সেই দিনগুলো চোখে ভাসছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে, বুকের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যথা লাগে।
১৯ জুলাই আমার পুরোনো হেল্পিং হ্যান্ডের বড় ছেলে সোহাগকে মেরে ফেলল। ছেলেটা মাদরাসায় পড়ত। এত মৃত্যুর পরেও অনলাইনে কিছু মানুষ শেখ হাসিনার দালালি করেছে। কীভাবে এগুলো সহ্য করছে মানুষ?
২২ জুলাইয়ের সেই অকটেন হাতে হুমকি দেওয়া ছেলেটার ছবি আজও চোখে ভাসে। আমি জানি না সে আজ কোথায় কিন্তু জানি তার মতো হাজারো মানুষকে প্রশ্রয় দেওয়াই আমাদের সমাজকে আজ এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
জুলাই শুধু রক্তঝরার মাস নয়, জুলাই আত্মপরিচয়ের মাস, প্রতিবাদের সূচনা, মানবতার পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার। সেই মাসে আরও দৃঢ়ভাবে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, জীবন মানে অন্যায়কে অন্যায় বলে বেঁচে থাকা, জীবন মানে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
লেখক : ডেপুটি মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণ), জাতীয় নাগরিক পার্টি