যখন থেকে বুদ্ধি হয়েছে, তখন থেকেই শুনে এসেছি মুক্তিযুদ্ধ, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান আর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের গল্প। বই পড়ে জানার চেষ্টা করেছি সেই দিনগুলোর কথা, কীভাবে মানুষের শক্তি এক হয়ে স্বাধিকার অর্জন করেছিল। কিন্তু কখনো ভাবিনি, আমার প্রজন্ম এমন এক গণ অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হবে, যা ইতিহাসের নতুন অধ্যায় হিসেবে লেখা হবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল বর্তমানে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর থেকেই ১৫ বছর ধরে সাধারণ মানুষ নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও বেশির ভাগ দল অংশ না নেওয়ায় ১৫৩টি আসনে এমপি হন সরকারপক্ষীয় প্রার্থীরা, যেখানে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচন ও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনও এ দেশের জনগণ দেখেছে। ক্ষমতার এই একচ্ছত্র দখল মানুষকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। তাছাড়া এর আগে থেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের অবাধ আচরণ, দখলদারি, চাঁদাবাজি এবং নিজেদের মধ্যকার খুন-খারাপ কার্যকলাপ দেখে সাধারণ মানুষ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ১৫ বছরের এই স্বৈরাচারী শাসনকে ভেঙে দিতে শুরু হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র-জনতা আন্দোলন। ছাত্রদের সামান্য কোটা আন্দোলন থেকে রূপ নেয় বৃহৎ জনআন্দোলনে। আন্দোলনে গুলি করে ছাত্র হত্যা, নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা-এসব ১৫ বছরের জমে থেকে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে আরও বেশি প্রতিবাদী করে তোলে। সেই প্রতিবাদের আগুনে ছারখার হয়ে যায় স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার গড়ে তোলা ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন। ছাত্র-জনতার লাশে ভাঙে ১৫ বছরের স্বৈরশক্তি।
জুলাই মাসজুড়ে সারা দেশে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়। আন্দোলনের নয় দফা দাবি এক দফায় পরিণত হয়। চট্টগ্রামেও বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। সরকার অশান্তি নিয়ন্ত্রণে না পেরে কারফিউ জারি করে, পুরো দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। বাড়ি বাড়ি পুলিশ তল্লাশি চালায়, নিরীহ শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। ভাইয়ের খুনের বিচার চাইতে ৪ আগস্ট সকাল থেকেই চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড় মানুষের সমুদ্রে পরিণত হয়। সেদিন অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট থাকলেও কঠোর নির্দেশনা ছিল যাতে আগে নিজে সুরক্ষিত থাকি। সেদিন চোখের সামনে ছিল শুধু মানুষের ঢল, মুখে মুখে স্লোগান- ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না,’ ‘এক দফা এক দাবি, খুনি হাসিনা কবে যাবি।’ আমি তখন ঝলসা মার্কেটের ১০ তলা ভবনের ৯ তলায় অবস্থান নিয়ে ছবি ও প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ ছোড়ে টিয়ার শেল। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। চোখ জ্বালা ধোঁয়ায় আমরা কয়েকজন সাংবাদিক ওই ভবনের একটি কক্ষে আটকে পড়ি। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আগুন আর টুথপেস্ট দিয়ে আমাদের সাহায্য করে। বিকালে আবারও ছাত্র-জনতা ফিরে আসে, নিউমার্কেট দখল করে নেয়। প্রায় ৭ ঘণ্টা আটকে থাকার পর সুযোগ বুঝে কোনোভাবে দৌড় দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি। এরপর দ্রুত অফিসে রিপোর্ট জমা দিয়ে বাসায় চলে যাই। পরদিন ছিল ৫ আগস্ট ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি।