সমস্যাগ্রস্ত শরিয়াহভিত্তিক বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খুব শিগগির এসব ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা চরমে পৌঁছেছে। জমানো টাকা তুলতে না পেরে শাখায় শাখায় প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে গ্রাহকের কান্না, ক্ষোভ আর অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস।
ঢাকার দিলকুশা শাখায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক আমিনুর রহমান জানালেন, আগে প্রতিদিন অল্প অল্প টাকা দিলেও এখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা দিয়ে গ্রাহককে বিদায় করা হচ্ছে। ‘আমি নিজের টাকাই তুলতে পারছি না, এই কষ্ট কাকে বলব?’ ক্ষোভ ঝরছে তাঁর কণ্ঠে। তাঁর মতে, ‘লাখ টাকার জায়গায় মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে আমি কী করব? আমার প্রয়োজন মিটবে না।’
তিনি আসলে জানেন এক দিন আগেই ব্যাংকটি অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একই অবস্থা ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখায়। শাখা ব্যবস্থাপক অনুপস্থিত থাকলেও অন্য এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা বন্ধ থাকায় এক মাস ধরে গ্রাহকদের এক টাকাও ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ জন গ্রাহক এসে খালি হাতে ফিরছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও মাসের শেষে নিজেদের বেতন তুলতে পারছেন না।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার এক কর্মকর্তা জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর আমরা একেবারেই ফেঁসে গেছি। গ্রাহকরা প্রতিদিন লাইনে দাঁড়িয়ে অপমান-গালি দিয়ে যাচ্ছেন।’ কথা বলতে বলতে তিনি আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন। এ চিত্র শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের।
গ্রাহকদের ভোগান্তি যেন এখন মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। চিকিৎস খরচ, সন্তানের স্কুলের বেতন কিংবা ব্যবসার জরুরি প্রয়োজনে জমা টাকা তুলতে না পেরে অনেকে ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছেন। কিছু শাখায় বাগবিতণ্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে।
অবস্থা এতটাই নাজুক যে স্কুল শিক্ষক আবদুল কাদের ১৮ বার ইউনিয়ন ব্যাংকে গিয়ে নিজের এক লাখ ২৭ হাজার টাকা থেকে এক হাজারও টাকাও তুলতে পারেননি। সাদ্দাম হোসেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে টাকার জন্য ঘুরলেও একটি টাকাও পাননি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার খেসারত এখন দিচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ১৪টি পর্ষদ বিলুপ্ত করে, প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা নতুন ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছিল। কিন্তু তা দিয়ে সংকট কাটেনি। বরং বড় অঙ্কের আমানতকারীরা এখনো এক টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, মার্জ হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের মোট আমানত এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা এবং ঋণ এক লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭৭ শতাংশ। মূলধনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। গ্রাহক সংখ্যা ৯২ লাখ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ লুট হয়ে গেছে। এ খাত পুনর্গঠনে প্রয়োজন ৩৫ বিলিয়ন ডলার।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং মার্জার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সময় লাগবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ গ্রাহকদের টাকার সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতেই কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মার্জার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যাংকই কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। যেহেতু সাময়িকভাবে এই ব্যাংকগুলোর মালিকানা রাষ্ট্রের কাছে চলে আসবে, রাষ্ট্রই তাদের আমানতের সুরক্ষা প্রদান করছে। তাই আমানতকারীদের হতাশ হওয়ার কিছুই নেই।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত