প্যানক্রিয়াস অর্থাৎ অগ্ন্যাশয়ের টিউমারে বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছেন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ব্যবসায়ী সাহিদুর রহমান (৬৫)। তিনি বলেন, সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতা বাড়লে সার্জারির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। টিউমার জটিল আকার ধারণ করায় রোবোটিক সার্জারিতে ঝুঁকি কম হবে বলে জানান। কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের সার্জারি চালু না থাকায় আমাকে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে। সার্জারি করতে দেশের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি খরচ হবে বিদেশের হাসপাতালে।
দেশে রোবোটিক সার্জারির প্রচলন নিয়ে চলছে আলোচনা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারস্পেশালাইজড হাসপাতালে রোবোটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু হয়েছে। দেশে রোবোটিক সার্জারিকে বিকশিত করতে আগ্রহী বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এজন্য বেশ কিছু হাসপাতাল রোবট আমদানির অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। কিন্তু প্রায় তিন মাস ধরে আবেদন পড়ে আছে। সরকারের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর না পাওয়ায় আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। আমলাতন্ত্রে আটকে আছে রোবোটিক সার্জারি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার চাইছে দেশে রোবোটিক সার্জারি চালু করতে। এর জন্য ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বেসরকারি হাসপাতাল আবেদন করে থাকলে সে বিষয়ে খোঁজ নেব। দেশের হাসপাতালে রোবটিক সার্জারি চালু করতে আমরা প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিক রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনে বিষয়ে সরকার ইতিবাচক। স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে আমরা কাজ করছি।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের হাসপাতালে সার্জারির জন্য বিদেশ থেকে রোবট কেনা এবং হাসপাতালে সংযোজনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। রোবট আমদানির অনুমোদন চেয়ে এর মধ্যেই এভারকেয়ার, ইউনাইটেড, ল্যাবএইডসহ বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল আবেদন করেছে। কিন্তু প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে পড়ে আছে এসব আবেদন।
একটি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, ‘সরকার স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। আমাদের সঙ্গে বেশ কিছু মিটিংয়েও তারা সে ধরনের বার্তা দিয়েছে। দেশে রোবটিক সার্জারি চালু হলে রোগীদের আর বিদেশ যেতে হবে না। সিঙ্গাপুরে যে অপারেশনের জন্য ১০ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে, দেশে ১ লাখ টাকায় সে অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও রোবট কেনার আবেদন দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে পড়ে আছে। তারা অনুমোদন দিলে আমরা রোবট কেনার যাবতীয় কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারব।’
বৈশ্বিক মানের চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিভিত্তিক চিকিৎসাব্যবস্থা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাড়ছে বিদেশগামী রোগীর ভিড়। চীনে হাসপাতালে সার্জারি থেকে শুরু করে সব ধরনের সেবা দিচ্ছে রোবট ডাক্তার এবং নার্স। বিশ্বে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত হাসপাতাল চালু করেছে চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। এ ভার্চুয়াল হাসপাতালের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এজেন্ট হাসপাতাল’। এর আগে দেশে প্রথমবারের মতো হৃদরোগ চিকিৎসায় রোবটিক এনজিওপ্লাস্টি বা রোবট দিয়ে হার্টের রিং পরানো হয়েছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোবটের মাধ্যমে এই রিং পরানো হয়। দেশে রোবটিক চিকিৎসার প্রচলন করতে এর মধ্যেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন চিকিৎসকরা।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জেনারেল অ্যান্ড অ্যাডভান্স এন্ড্রো-ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. সরকার কামরুন জাহান ঝিনুক রোবটিক সার্জারির ফেলোশিপ ডিগ্রি অর্জনকারী ও দেশের প্রথম রোবোটিক পাসপোর্টধারী। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। ’৯০-এর দশকে কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসকের হাত ধরে দেশে ল্যাপরোস্কপি সার্জারি শুরু হয়। পৃথিবীর অন্য দেশে চালু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশে এ চিকিৎসা শুরু হয়েছিল। এরপর এন্ডোসকপি সার্জারির প্রচলন শুরু হতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। এরপর রোবটিক সার্জারির প্রচলন শুরু হয়। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) রোবটিক সার্জারিকে অনুমোদন দেয়। ইতোমধ্যেই অন্য দেশ প্রযুক্তিতে পাঁচ জেনারেশন এগিয়ে গেছে। এখনো পুরোদমে রোবটিক সার্জারি শুরু না হলে আমরা আরও পিছিয়ে যাব।’