ইত্যাদি সব সময়ই অনন্য, অনবদ্য। এবারে কুড়িগ্রামে ধারণকৃত ইত্যাদি যেন অদ্ভুত এক মায়ায় ভরা। নন্দিত নির্মাতা হানিফ সংকেত কীভাবে প্রত্যন্ত দুর্গম চরে গিয়ে প্রাণোচ্ছল শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছেন, জেনেছেন তাদের উচ্ছলতার গহিনে লুকিয়ে থাকা অতি-বাস্তব জীবনগাথা! ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাশাপাশি সেখানকার সমস্যা ও সম্ভাবনা- দুটোই উঠে এসেছে সুনিপুণ দক্ষতায়। এবারের পর্বে ‘বেশ মহাসমারোহে’ উঠে এসেছে মূলত ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়াকে নিয়ে এবারের ইত্যাদির বিভিন্ন পর্ব আবারও প্রমাণ করেছে যে, ইত্যাদি হলো শিকড়-সন্ধানী। ভাওয়াইয়া ভাস্কর খ্যাত ভূপতি ভূষণ বর্মাকে নিয়ে ব্যতিক্রমী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভাওয়াইয়ার ইতিহাস, নামকরণসহ নানা বিষয়। তিনি নিজে গান গেয়েছেন, তাঁর দলের ছোট্ট সোনামণিরা কী অদ্ভুত মায়াবী কোরাসে গেয়েছে ‘ও মুই না শোনোং না শোনোং তোর বৈদেশিয়ার কথা রে।’ দর্শকপর্বেও নির্বাচিত চারজন দর্শক গেয়েছেন চারটি জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান। দর্শকপর্বে এবারে ছিল ভাওয়াইয়া। চরাঞ্চলের প্রতিবেদনেও হানিফ সংকেত ভাওয়াইয়াকে এনেছেন।

এবারের অনুষ্ঠানের মূল গান ছিল ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, গানটি গেয়েছেন সালমা আক্তার ও পূর্ণ চন্দ্র রায়। পূর্ণচন্দ্র পুরোদস্তুর ভাওয়াইয়া শিল্পী। বাড়িও লালমনিরহাটে। আর সালমা আক্তার এ প্রজন্মের জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী। শত শত বছরের পুরনো এ ভাওয়াইয়া গান নতুন প্রজন্মের এ দুই শিল্পীর কণ্ঠে অসাধারণ লেগেছে। মূলত আমাদের লোকজ সম্পদগুলোর উৎপত্তি এক স্থানে হলে তাতে অধিকার থাকে সবার। কোনো শৃঙ্খলে সেটি বাঁধা থাকে না। আঞ্চলিকতা ও কালের গণ্ডি পেরিয়ে লোকসংগীত লোকের মুখে মুখে ফিরবে, আর এখানেই শিল্পের সার্থকতা। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশিত দলীয় নৃত্য-গীত ছিল উপভোগ্য। প্রতিটি জেলায় ইত্যাদি পরিবেশিত পরিচিতিমূলক এ গান প্রতিটি জেলারই থিম সং হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চরাঞ্চল নিয়ে করা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিও বেশ তথ্যবহুল। চরাঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাল্যবিবাহের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি ‘চর পর্যটন’-এর ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাতায়াত ও আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে চরাঞ্চলও যে ভিন্ন স্বাদের পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে এবারের ইত্যাদিতে। শুরুতেই ছিল কুড়িগ্রাম জেলার ওপর প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে কুড়িগ্রামের প্রকৃতি-প্রত্নসম্পদ ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের। ভালো লেগেছে নরেন্দ্রনাথ দেব উদ্ভাবিত ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকিকল, ভাওয়াইয়াসম্রাট আব্বাস উদ্দীনের গাওয়া গানের ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দর, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভুরুঙ্গামারীর বাড়ি ও নাতি মনিরুজ্জামান খানের সাক্ষাৎকার আর রৌমারী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ অনেক প্রাচীন প্রত্নসম্পদ। চিলমারী উপজেলার রিক্তা আক্তার বানুকে নিয়ে করা আরেকটি প্রতিবেদন আমাদের সমাজ-বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে স্কুলে ভর্তি না নেওয়ায় ২০০৯ সালে নিজেই প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৩ শিক্ষার্থী নিয়ে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানে এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০০। ২০২৪ সালে বিবিসি প্রকাশিত বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম। এ যেন এক সাহসী মায়ের অকুতোভয় সংগ্রামের হৃদয়ছোঁয়া বীরত্বগাথা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও চরের হতদরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য নাগেশ্বরীতে আবদুল কাদেরের ‘১০ টাকার হাসপাতাল’ ও ফুলবাড়ী উপজেলায় তৌহিদুল ইসলাম নামে এক শিক্ষকের গড়ে তোলা ‘বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর’ নিয়ে করা প্রতিবেদন দুটিও বেশ অনুপ্রেরণামূলক। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কিছু নাট্যাংশও বেশ প্রশংসনীয়। ঢাকায় বিভিন্ন দাবি-দাওয়ায় রাস্তাঘাট বন্ধের কারণে প্রচণ্ড যানজটে নিম্নআয়ের মানুষের চরম দুর্ভোগের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এআই, ফেসবুক, টকশোর অতিথিদের নিয়ে রসাত্মক কিন্তু বিদ্রুপাত্মক কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে এবারের ইত্যাদিতে। বরাবরের মতো নাতিকে নিয়ে পর্ব ও বিদেশি প্রতিবেদনও ছিল বেশ উপভোগ্য।
পরিশেষে বলা যায়, ১৫৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত কুড়িগ্রামের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ধারণকৃত ও বিটিভিতে প্রচারিত এবারের ইত্যাদি ছিল অসাধারণ, অনন্য ও অপরিমেয় মায়ায় ভরা।