সুদানের চলমান সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছেন এক ভয়ংকর নাম—মোহাম্মদ হামদান দাগোলো, যিনি সবার কাছে ‘হেমেদতি’ নামে বেশি পরিচিত। উট বিক্রি করে জীবন শুরু করা এই ব্যবসায়ী আজ অর্ধেক সুদানের নিয়ন্ত্রক। তাঁর নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এখন দেশটির পশ্চিমাংশসহ বিশাল ভূখণ্ড দখলে রেখেছে। সম্প্রতি তারা সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের শহর দখল করে নেয়। জাতিসংঘের মতে, ১৮ মাসের অবরোধে ওই শহরে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।
বিবিসির তথ্যমতে, দাগোলো কখনোই সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেননি। তিনি রিজেইগাত সম্প্রদায়ের মহারিয়া শাখার উট ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। ১৯৭৪ বা ১৯৭৫ সালে জন্ম নেওয়া দাগোলো কিশোর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন এবং লিবিয়া ও মিসরে উট ব্যবসা শুরু করেন।
সে সময় দারফুর ছিল অরাজক অঞ্চলের নাম। আরব মিলিশিয়া জাঞ্জাউইদ গোষ্ঠী নিয়মিত হামলা চালাত ফুর জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলোতে। ২০০৩ সালে দারফুরে বিদ্রোহ শুরু হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির এই জাঞ্জাউইদ বাহিনীকে সমর্থন দেন। তাদের হাতে সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে শত শত গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পরবর্তীতে এটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
দাগোলোও তখন ছিলেন এই বাহিনীর একজন কমান্ডার। ২০০৪ সালে আদওয়া গ্রামে ১২৬ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাঁর ইউনিটের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিদ্রোহের পর বেতন ও ভাইয়ের জন্য পদ দাবি করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেও তিনি বেঁচে যান। বরং বশির তাঁকে পুরস্কৃত করেন এবং আরও ক্ষমতা দেন।
এই সুযোগেই দাগোলো নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। দারফুরের জেবেল আমির অঞ্চলের সোনার খনি দখল করে প্রতিষ্ঠা করেন পারিবারিক কোম্পানি ‘আল-গুনাইদ’, যা দ্রুতই সুদানের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে।
২০১৩ সালে তিনি গঠন করেন র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। প্রথমে এই বাহিনী কাজ করত সরাসরি প্রেসিডেন্ট বশিরের অধীনে। পরে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের হয়ে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে দাগোলো গড়ে তোলেন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। বিশেষ করে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে তিনি বিপুল অর্থ ও অস্ত্রশক্তি অর্জন করেন।
২০১৯ সালে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের সঙ্গে মিলে প্রেসিডেন্ট বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেন দাগোলো। শুরুতে তাঁকে সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হলেও শিগগিরই প্রকাশ পায় তাঁর নির্মম চরিত্র। প্রতিবাদীদের ওপর আরএসএফ বাহিনীর গুলিতে শত শত মানুষ নিহত হয়; নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগও ওঠে।
২০২১ সালে বুরহান ও দাগোলো একসঙ্গে ক্ষমতা দখল করলেও খুব দ্রুত তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০২৩ সালের এপ্রিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে রাজধানী খার্তুমসহ দারফুরে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শুধু দারফুরেই ১৫ হাজারের বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।
বর্তমানে আরএসএফ আধুনিক ড্রোন ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত এবং পশ্চিম সুদানের প্রায় সব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে। দাগোলো নিজেকে “শান্তি ও ঐক্যের সরকার”-এর প্রধান ঘোষণা দিয়েছেন, যা মূলত এক সমান্তরাল সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দাগোলো হয়তো নতুন এক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করছেন, আবার কেউ মনে করেন তিনি এমন এক ছায়াশক্তি হতে চান—যার হাতে থাকবে অর্থ, অস্ত্র ও রাজনীতি—যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় না থেকেও তিনি পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/আশিক