আজ এদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ছবি ‘রূপবান’ মুক্তির ষাট বছর পূর্ণ হলো। এখনো দর্শক স্মৃতিতে অমলিন এ ছবিটি। ১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর এদেশের চলচ্চিত্র জগতে বাংলা ছবির পক্ষে ঘটে যায় এক মহাবিপ্লব। ষাট দশকে এদেশে চলছিল পাকিস্তানি উর্দু ছবির জয়জয়কার। উর্দু ছবির চাপে বাংলা ছবি কোনোভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছিল না। তখন চিত্রপরিচালক সালাউদ্দিন চরম ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এলেন। ফোকগাঁথা গল্প নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘রূপবান’ নামের একটি বাংলা ছবি। দুরু দুরু বুকে কাজটা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত বাংলা ছবির সোনালি দুয়ার খুলে দিলেন সালাউদ্দিন ও তার চ্যালেঞ্জের ফসল ‘রূপবান’। এ ছবি এতটাই দর্শকনন্দিত হলো যে, এদেশে উর্দু ছবি রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে গেল। রূপবান দিয়েই শুরু হলো বাংলা ছবির জয় জয়কার।
ছবিটির ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে এ ছবির নায়িকা সুজাতা শুটিংকালের স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, রূপবান ছবির শুটিং হয় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। একটি সিন ছিল তাজেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে রহিম বাদশা। তাজেলের প্রতি রহিমের এমন আসক্ত হওয়ায় একটা বাঁশ ধরে গান গেয়েছিল রূপবান। সেই বাঁশটা নাকি পরে নিলামে উঠেছিল। বছর তিনেক আগে বাঁশটি যিনি কিনেছেন তার সঙ্গে দেখা। বুড়ো হয়ে গেছেন লোকটি। উনিই আমাকে চিনে বলেছেন। শিল্পকলার এক অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে বলেন, সুজাতা আপা আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি রূপবান ছবিতে যে বাঁশটি ধরে গান গেয়েছিলেন, সেই বাঁশটি কিন্তু আমি কিনেছিলাম। পাকিস্তান পিরিয়ডে একটা বাঁশের দাম তখন বড়জোর এক আনা। অথচ সেই বাঁশটা তিনি কিনেছিলেন সাড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে! ভাবা যায়। বাঁশটি নাকি যত্ন করে বালিশের পাশে এখনো রেখে দিয়েছেন তিনি। এটাই আমার প্রাপ্তি। বছরখানেক আগে সিলেটের সেই ভদ্রলোক মারা গেছেন।
রূপবান ছবির মূল পরিকল্পনায় ছিলেন সালাউদ্দিনের সহকারী সফদার আলী ভূঁইয়া। তখন ছবিটির বাজেট ছিল দেড় লাখ রুপি। বক্স অফিসে ছবিটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর বাণিজ্যিক সাফল্য অতীতের সব রেকর্ড ভাঙে। চলচ্চিত্রের দেশীয়করণে ‘রূপবান’-এর ভূমিকা ছিল অনন্য। ছবিটি তখন প্রায় ২০ লাখ রুপির ব্যবসা করে।
চলচ্চিত্র সমালোচক চিন্ময় মুৎসুদ্দী ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সামাজিক অঙ্গীকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ষাট দশকের প্রথম দিকে যেখানে অন্যান্য বাংলা চলচ্চিত্রের মাত্র চার বা পাঁচটি সিনেমা হলে রিলিজ হতো, সেখানে রূপবান ১৭টি হলে রিলিজ হয়েছিল। শুধু রূপবানের প্রদর্শনীর জন্য গ্রামীণ এলাকায় অনেক অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করা হয়েছিল। টিনের চালার এসব প্রেক্ষাগৃহ, অ্যানালগ সিনেমা হলের পর্দা আর কাঠের বেঞ্চের ছারপোকার ছড়াছড়ির মাঝেই নিজেদের স্থান করে নিতেন রূপবানের দর্শকরা। ঢাকার স্টার সিনেমা হলে প্রতি বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ছিল নারীদের জন্য বিশেষ শো-এর ব্যবস্থা। ১৯৬৫-পরবর্তী যুগকে সিনে-সাংবাদিকরা রূপবান যুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তখন রূপবানের ভূত চেপেছিল সর্বত্রই। রূপবান সিগারেট, রূপবান আলতা, রূপবান ঘুমের বটিকা, রূপবান মার্কা কেরোসিন তেল থেকে শুরু করে আরও কত কী। ১২ বছরের রূপবানের সঙ্গে রাজপুত্র রহিম, যে কিনা সদ্য জন্মলাভ করেছে, তার বিয়ের মাধ্যমে এ কাহিনির বিস্তৃতি ঘটে। তারপর দৈববাণীর কল্যাণে ১২ দিনের স্বামী রহিমকে নিয়ে ১২ বছরের রূপবানের বনবাস। রূপবানের বনের সংগ্রামী জীবন, রহিম বাদশার বেড়ে ওঠা, অপর রাজকন্যা তাজেলের প্রেমে পড়া, পরিশেষে অমোঘ সত্য প্রকাশিত হওয়ার বিষয়াদিই রূপবান লোককাহিনির উপজীব্য। ছবিটির প্রযোজনা ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক স্বয়ং।

বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা, মনসুর, চন্দনা, আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, তেজেন চক্রবর্তী, তন্দ্রা, রহিমা ও হেলেন। কলাকুশলীদের মধ্যে ছিলেন চিত্রগ্রহণে আবদুস সামাদ, সংগীত পরিচালনায় সত্য সাহা, শব্দ গ্রহণে মনি বোস ও সম্পাদনায় বশীর হোসেন। সুজাতা আজিমের লেখা ‘আমার আত্মজীবনী’তে খুঁজে পাওয়া যায় ‘রূপবান’ সংশ্লিষ্ট আরও নানা তথ্য। ‘রূপবান’ চরিত্রে অভিনয়কারী সুজাতার পারিবারিক নাম ছিল তন্দ্রা মজুমদার। পরিচালকের কল্যাণে সেটা হয়ে যায় সুজাতা। রূপবান মুক্তির পর ছবিটির জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে ওঠে, নায়িকা সুজাতাকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জেলায় কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অনুরাগীদের ঢল ঠেকানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন করতে হয়েছে। গ্রামের যেসব মা-চাচি ইতিপূর্বে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার কথা চিন্তাও করেননি, তারাও ‘রূপবান’ দেখতে গরু-মহিষের গাড়িতে হলমুখী হয়েছিলেন। ‘ও দাইমা কীসের বাদ্য বাজে গো’, ‘সাগরকূলের নাইয়ারে’, ‘মনের দুঃখ কইনারে বন্ধু রাইখাছি অন্তরে’, ‘বিদায় দেন বিদায় দেন’ শিরোনামে রূপবানের বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান তখন হরহামেশাই লোকমুখে শোনা যেত। তৎকালীন দৈনিক পত্রিকায় ‘রূপবান’-এর বিজ্ঞাপন থেকেও ছবিটির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যায়। ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ‘রূপবান : ৩৬তম সপ্তাহ রূপমহলে’ শিরোনামে বিজ্ঞাপন। এটি বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।