উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অতিদারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট আরও বেড়েছে। যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অন্তরায়। যদিও চলতি অর্থবছরকে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত এক বছরে দেশের অর্থনীতি আরও সংকুচিত হয়েছে। এদিকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। এবার এই তিন সংস্থার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে হলে দারিদ্র্য কমাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ।
একই সঙ্গে সরকারকে অভ্যন্তরীণভাবে খাদ্যনিরাপত্তা বাড়ানোর পরমার্শ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি দেশের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে নেমে গেছে। ৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে খাদ্যপণ্যের মজুতের পরিমাণ নেমেছে ১৩ লাখ ৬৯ হাজার টনে। ঢাকায় সফররত আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে। গতকালও অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, খেলাপি ঋণ, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। এ ছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা আরও জোরদারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থা। এদিকে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত চার বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ২৮ শতাংশ উঠেছে। প্রতি বছর ৩ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপ কোনোভাবেই কমাতে পারছে না সরকার। চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী। যার ফলে অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির গড় খুবই বিপজ্জনক সীমায় বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইএমএফ। জানা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ সাফল্য দেখালেও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটেছে। করোনা মহামারির পর পর আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। আবার কয়েক বছর ধরে দেশিবিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি থমকে আছে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার হয়ে পড়েছে। কেননা তারা কাক্সিক্ষত হারে কাজ পাচ্ছেন না। যে কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারি সংস্থা বিবিএসের ২০২২ সালের জাতীয় খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, ওই বছর দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর আর এই জরিপটি হয়নি। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেবেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। গত মে মাসে এই গবেষণা করা হয়। এ ছাড়া ১৮ শতাংশ মানুষ যে কোনো সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অর্থাৎ এই হিসাব আমলে নিলে বলতে হবে- গত তিন বছরের মধ্যে দরিদ্র লোকের সংখ্যা বেড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১০ জন। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রতি ৪ জনে ১ জন দরিদ্র। অথচ ২০১৬ সালের বিবিএসের হিসাবে, দেশে দারিদ্র্যহার ছিল ২৪ শতাংশের মতো।
এদিকে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে। আর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার টার্গেট করা হয়েছে। এর দুটোকেই অসম্ভব হিসেবে আখ্যা দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে। যদিও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।
সংস্থাটি আরও বলছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হওয়ার জন্য দায়ী দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি, অধিক বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের সংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এজন্য অতিদারিদ্র্য থেকে মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে উৎপাদন ও আমদানি বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘দারিদ্র্য হলো যে কোনো দেশের জন্য খুবই ভয়ানক অভিশাপ। আমরা অতীতে ওই অবস্থা থেকে কিছুটা উন্নতি করলেও বর্তমানে আবারও দারিদ্র্য বেড়েছে। এজন্য আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’ একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেন এই অর্থনীতিবিদ।