ইরানের জাগোস পর্বতমালা থেকে সুবে বাংলার মানুষদের সালাম ও শুভেচ্ছা। একটি পাহাড়ি বন্য ছাগলের আত্মকথন শুনতে তোমাদের কেমন লাগবে তা আমি বলতে পারব না। তবে সুবে বাংলা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত, প্রকৃতির অনবদ্য সৃষ্টি জাগোস পর্বতমালায় এক লাখ বছর ধরে বসবাসরত একটি ছাগল প্রজাতির বংশধর হিসেবে টিকে থাকা অকালপক্ব ছাগলের কাছে তোমাদের খবর কিভাবে পৌঁছাল এবং আমি কেন তোমাদের আমার জীবনকাহিনি শোনাতে চাচ্ছি, তা নিশ্চয়ই তোমাদের কিছুটা হলেও বিনোদিত করবে। আমার সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আগে দুটো বিষয় ব্যাখ্যা করা জরুরি।
প্রথমত, আমি কেন তোমাদের আপনি বলার পরিবর্তে তুমি বলে সম্বোধন করছি এবং দ্বিতীয়ত, কেন আমি নিজেকে অকালপক্ব বলে পরিচয় দিলাম! তোমরা হয়তো অনেকেই জানো-আমাদের চারণভূমি থেকেই পৃথিবীর প্রথম ছাগল পয়দা হয়েছিল এবং আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষদের একটি গোত্র নেমে এসেছিল এবং পাহাড় ছেড়ে সমভূমিতে গিয়ে আমরা মনুষ্য প্রজাতিকে দুগ্ধপান শিখিয়েছিলাম। আমাদের সেই বশ্যতা-বন্ধুত্ব এবং আত্মত্যাগকে মনুষ্য প্রজাতির মাংসভুক সম্প্রদায় কিভাবে কাজে লাগিয়েছে তা ঢাকার স্টার কাবাব, আল রাজাক প্রভৃতি হোটেলে গিয়ে খাসির লেগ রোস্টের ওপর ভোজনবিলাসীদের হুমড়ি খাওয়ার দৃশ্য দেখলেই বুঝতে পারবে।
তো যা বলছিলাম-আমরা হলাম পৃথিবীর তাবৎ ছাগল জাতির আদি পুরুষ বা আদি পিতা। তোমাদের দেশে যত ছাগল আছে এমনকি সারা দুনিয়ায়-সে এক হাজার মিলিয়ন ছাগল রয়েছে তাদের সর্দার বলো-নেতা বলো অথবা পিতা বলো, সবই আমার এবং আমার পূর্ব পুরুষদের হক।
তা ছাড়া তোমাদের সমাজে যারা ছাগল স্বভাবের মানুষ এবং যারা ছাগলের মতো আচরণ করে ও সেই আচরণের জন্য রীতিমতো গর্ব অনুভব করে তাদের উচিত আমার অকালপক্বতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। আমি এবং আমার ভাই ব্রাদাররা মাত্র তিন মাসের মধ্যে যৌবনপ্রাপ্ত হই। অর্থাৎ জন্মের নব্বই দিনের মধ্যেই আমরা সন্তান উৎপাদনের পৌরুষ এবং গর্ভধারণের জন্য মাতৃগর্ভের অধিকারী হই। শুধু তাই নয়, তিন মাস বয়সে আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে তিন হাজার মিটার অর্থাৎ প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ে উঠতে পারি। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেভাবে লাফ দিয়ে চলে যাই, তা দেখে আমাদের খেতে আসা নেকড়ে, বাঘ, এমনকি ইগলরা পর্যন্ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
আমি দিব্যি করে বলতে পারি, তোমাদের দেশের ছাগলরা তিন মাস বয়সে কচি খোকার মতো কচি কচি পাতা খায়-মায়ের পেছনে ঘুরঘুর করে এবং সারাক্ষণ তিড়িং বিড়িং করে লাফ মারে। আর তিন মাস বয়সী ওয়া ওয়া চুয়া চুয়া মনুষ্য শিশু কী করে তা বলে তোমাদের আর লজ্জায় ফেলতে চাই না। সুতরাং কোন যোগ্যতায় এবং অধিকারে আমি তোমাদের তুমি বলে সম্বোধন করছি তা যদি তোমরা এখনো না বুঝে থাকো, তবে তোমাদের আরো কিছু তথ্য দিই- শুনতে পেলাম তোমরা নাকি ইদানীং বর্বর থেকে সভ্য হয়েছ। মানুষের বর্বরতার ইতিহাস বহু পুরনো এবং সভ্যতার ইতিহাস সাম্প্রতিক।
পৃথিবীর এক হাজার মিলিয়ন ছাগল সেই প্রাগৈতিহাসিক আমল অর্থাৎ লক্ষ বছর আগেও আজকের জামানার মতোই সভ্য-নম্র-ভদ্র এবং পরের তরে জীবন দিয়ে যাচ্ছি। আমরা কোনোকালে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ও ছিনতাই করিনি। অন্যের ওপর জুলুম-অত্যাচার-গুম-খুন আমরা কোনো দিন করিনি। আজ থেকে লক্ষ বছর আগে আমার পাহাড়ি বনে চারণভূমিতে যেভাবে খেতাম, মলমূত্র ত্যাগ করতাম ঠিক একইভাবে আমরা আধুনিক যুগেও চরিত্র পাল্টাইনি। তোমাদের মধ্যে যারা আমাদের বন্দি করে মাংস-চামড়া এবং হাড়গোড়ের ব্যবসা করো, তারা আমাদের নানা রকম অখাদ্য-কুখাদ্য জোর করে খাইয়ে আমাদের শরীর-মন-চরিত্র এবং আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে থাকো। ফলে আমাদের অব্যক্ত কান্নায় তোমাদের পেটের পীড়া, বুকের ব্যামো, মস্তিষ্কে পোকা এবং চামড়ায় পচন দেখা দেয়।
প্রাকৃতিক পরিবেশে পৃথিবীর তাবৎ ছাগল একই রকম আচরণ করে। কিন্তু সুবে বাংলার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং আদম সন্তানদের অদ্ভুত চিন্তা-চেতনা ও কর্মের কারণে বহু দেশের ছাগলেরা নানা রকম কুকর্ম করে বলে আমি শুনেছি। ‘ছাগলে কি না খায় আর পাগলে কি না বলে’র মতো বাগধারা রচনা করে তোমরা বাংলার ছাগলদের সঙ্গে পাগলের তুলনা করেছ, তা যেমন আমাকে বিক্ষুব্ধ করে তেমনি তোমাদের দেশের ছাগলের দুটি কাণ্ড, যা দেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তা শোনার পর কিছুটা হলেও পুলক অনুভব করেছি।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল এক গ্রাম্য মাতুব্বর শ্রেণির লোকের সঙ্গে। লোকটি বাজার থেকে সদ্য আনা মাড়যুক্ত একটি লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পিরিতের কদবানুর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমের আলাপে বেখেয়াল সময় পার করছিল। এমন সময় কোত্থেকে এক সর্বভুক ছাগল এসে মাতুব্বর সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে তার লুঙ্গি ভক্ষণ শুরু করে দেয়।
তোমরা তো জানো-তোমাদের দেশের ছাগলরা কোনো বস্তু ভক্ষণ করতে গিয়ে মজা পেলে খাওয়ার সময় হালকা পাতলা গুঁতা দেয়। ওরা শিশুকাল থেকেই ওসব অভ্যাস রপ্ত করে এবং মাতৃদুগ্ধ পান করতে গিয়েও তারা মায়ের পেটে গুঁতা মারে। ওসব অসভ্যতামি আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের ছাগলরা করে না। আবহমান বাংলার চিরায়ত ছাগলামোর কারণে মাতুব্বরের লুঙ্গি খেতে খেতে ছাগলটি নিদারুণ মজা পেয়ে যায় এবং ভক্ষণের এক পর্যায়ে সজোরে লুঙ্গিতে টান মারে এবং মাতুব্বর সাহেবের পশ্চাৎ দেশে গুঁতা মারে। মাতুব্বর ঘটনার আকস্মিকতায় কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং ধারণা করেন কদবানুর স্বামী পেছন থেকে আক্রমণ করেছে। ফলে তিনি লুঙ্গি ফেলে ভোঁ-দৌড় দেন। ছাগল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এবং পুরো গ্রামে মাতুব্বরের বস্ত্রহরণ রীতিমতো মহাকাব্যে পরিণত হয়।
উল্লিখিত ঘটনা ছাড়া আরেকটি কাহিনিও আমি শুনেছি। একবার এক লোক পঞ্চাশ হাজার টাকার নতুন নোটের একটি বান্ডিল তার কাচারিবাড়ির টেবিলের ওপর রেখে গল্প করছিলেন। তিনিও মাতুব্বর গোছের লোক ছিলেন। টাকার বান্ডিলটি রেখে তিনি গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলার আড়ালে মূলত নিজের নগদ টাকার দাপট দেখাচ্ছিলেন। কথা বলতে বলতে তিনি লোকজনকে বিদায় জানাতে কাচারিবাড়ির উঠানে আসেন এবং সেই সুযোগে এক দুষ্ট ছাগল সেখানে ঢুকে টাকার বান্ডিল চিবুতে থাকে। মাতুব্বর যখন ফিরে আসেন, তখন বান্ডিলের দফারফা শেষ-অর্থাৎ বেশির ভাগ অংশ ছাগলের পেটে চলে গেছে।
ছাগল নিয়ে সুবে বাংলায় কত যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। হাজার হাজার বছর পর বাংলা, বিহার, ওড়িশা অঞ্চলের গ্রামের বেশির ভাগ ঝগড়াঝাঁঠি, মারামারি, খুনখারাবি হতো ছাগল নিয়ে। এক বাড়ির ছাগল অন্য বাড়িতে গিয়ে যে সর্বনাশ করত কিংবা যেভাবে ফসলের ক্ষেত-খামারে ঢুকে সব কিছু সাবাড় করে দিত তাতে করে ঝগড়াঝাঁটি অনিবার্য করে তুলত। ছাগলসংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে শশাঙ্ক জামানা থেকে শুরু করে মোগল জামানা পর্যন্ত সুবে বাংলার রাজকর্মচারীরা নিদারুণ পেরেশানির মধ্যে থাকতেন। কিন্তু ছাগলের যন্ত্রণা রোধ করা এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় বের করতে পারেনি। অবশেষে ইংরেজ জামানায় জনৈক সমাজবিজ্ঞানীর পরামর্শে ছাগলের জন্য সুবে বাংলায় সরকারি মদদে কারাগার প্রথা চালু হয়, যা স্থানীয় ভাষায় খোঁয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার প্রতিটি গ্রামে এক বা একাধিক অনুমোদিত ছাগলের কারাগার ছিল। কোনো ছাগল কারো ক্ষতি করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাগলকে না মেরে কিংবা ছাগলের মালিকের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি না করে ছাগলটিকে কারাগারে দিয়ে আসত। কারারক্ষক নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা আদায় করে ছাগলের মুক্তি দিতেন। আর এভাবেই ছাগলসংক্রান্ত বিরোধ বহুলাংশে কমে গিয়েছিল।
আমি আমার আত্মকথনের শেষ পর্যায় চলে এসেছি। কাহিনি শেষ করার আগে ছাগল ও প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিই। ছাগলরা খুবই কৌতূহলী প্রাণী। শুধু ছাগলের মধ্যে প্রায় তিন শ প্রজাতি রয়েছে। ভেড়া, হরিণ, দুম্বাদের মতো সমশ্রেণির প্রায় এক হাজার প্রজাতির মধ্যে ছাগলই উত্তম। পৃথিবীর সব প্রাণীরই কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে এবং সে তুলনায় ছাগল প্রজাতির নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নেই বললেই চলে। এটি প্রকৃতির একমাত্র প্রাণী, যারা কোনো রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটায় না, গরুর মতো কার্বন নিঃসরণ করে প্রকৃতির ক্ষতি করে না। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য কৌতূহল। শুধু কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে এরা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠে, কখনো কখনো সদলবলে কোনো একটি গাছে আরোহণ করে গাছের মগডালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এরা কৌতূহলবশত নদীতে ঝাঁপ দেয়, লাফালাফি করে এবং কখনো কখনো হারিয়ে যায় গহিন অরণ্যে, বিস্তীর্ণ ফসলের জমিতে কিংবা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে।
ছাগল প্রকৃতি থেকে কিছুই শিখে না, অনুসরণ বা অনুকরণ করে না। শুধু প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে মনুষ্য সমাজ অনুকরণপ্রিয় এবং প্রকৃতির সব প্রাণী উদ্ভিদ মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সবচেয়ে অবাক বিষয় হলো, মানুষের সঙ্গে যে প্রাণীর মতো সখ্য সেই অভ্যাস মানব মন-মননে ভীষণ রকম প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং সুবে বাংলার ছাগল অর্থাৎ ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট, তোমাদের চিন্তা-চেতনা, অভ্যাস-রুচি, চেহারা-চরিত্র, হাঁকডাক, লম্ফঝম্ফ, কৌতূহল, আনন্দ-স্ফূর্তি ইত্যাদিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করছে, তা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে তোমরা ভালো জানো।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ