স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত মানুষের সংগঠনই সমবায়। প্রথিতযশা বাঙালি কবি ও সমাজকর্মী কামিনী রায়ের ‘পরার্থে’ কবিতার একটি পঙিক্ত ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’কে সমবায়ের মূলনীতি হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সমবায় হচ্ছে অংশগ্রহণকারী জনগণের স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন। এর সদস্যরা যৌথভাবে পরিচালিত সম্পদ ও শ্রমের ভিত্তিতে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মিলিত স্বার্থে কাজ করে থাকে।
সমবায় মালিকানায় সদস্যদের অর্থনৈতিক দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হয়। এটি পরিচালিত হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কর্মসম্পাদনে স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহি সমবায়ের গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সমবায়ের সদস্যরা নিজেরা উৎপাদন করে, ভোগ করে ও বিপণনে অংশগ্রহণ করে।
সমবায়ের মাধ্যমে ছোট উদ্যোগগুলো লাভজনক হয়ে ওঠে এবং বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এর অংশীজন বেশি হলে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস পায়। বাজারে দর-কষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তাতে ভালো মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হয়। উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা যখন মানসম্পন্ন পণ্য ন্যায্যমূল্যে প্রদানে ব্যর্থ হয়, তখন সমবায় এর প্রতিকার হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সদস্যদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং আর্থিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বিস্তৃত করা। এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়ন, বৈষম্য হ্রাস, কর্ম সৃজন ও দারিদ্র্যমোচনে সমবায় হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। বাংলাদেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সংগঠন গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উপযোগমূলক সেবা, ভোগ্যপণ্য, শ্রম, পরিবহন, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবা, শিল্প, গৃহায়ণ, সঞ্চয় ও ঋণ প্রদান, বীমা এবং কৃষি উৎপাদন ও বিপণন সম্পর্কিত সমবায়। তন্মধ্যে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন বিষয়ক সমবায়ের পরিধি অনেক বিস্তৃত। অংশীজনের সাফল্য খুবই দৃশ্যমান।
কৃষি মানুষের সবচেয়ে পুরনো পেশা। সমবায়েরও আদি রূপ কৃষি সমবায়। এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে কৃষক ফসলহানির সংকট কাটিয়েছেন, কৃষিতে অর্থায়ন নিশ্চিত করেছেন, উপকরণ সহায়তা নিয়েছেন, উৎপাদনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছেন এবং পণ্য বিপণনে সফলতা পেয়েছেন। এতে কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়েছে কৃষির উৎপাদন। কৃষি সমবায়গুলোর মূল উদ্দেশ্য নিম্নরূপ :
ক. উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ হ্রাস; খ. ঝুঁকি উপশম করা; গ. প্রতিযোগিতামূলক পণ্যবাজারে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জন; ঘ. বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অভিগম্যতা প্রাপ্তি; ঙ. মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস; চ. কৃষি ব্যবসায় লাভজনকতা বৃদ্ধি করা এবং ছ. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
কৃষিকাজ বলতে বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশে ফসল ফলানো, খাদ্যশস্য উৎপাদন, পশুপাখি পালন, মাংস, দুগ্ধ ও ডিম উৎপাদন, মৎস্য চাষ, কৃষি বনায়ন ইত্যাদি সমষ্টিকে বোঝায়। এই বিশাল কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগী ভূমিকা পালন করেছে সমবায়। এগুলোর মধ্যে শস্য উৎপাদন ও বিপণন সমবায়, দুগ্ধ সমবায়, মৎস্য চাষি সমবায়, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সমবায়, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের সমবায়ের ক্ষেত্রে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব দেশে সমবায়ের বার্ষিক আয় পর্যাপ্ত। অংশীজনের সংখ্যাও অনেক বেশি। জাতীয় উৎপাদনে ও কর্ম সৃজনে দীর্ঘকাল ধরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছে কৃষি সমবায়। নিম্নে এর কিছু বিবরণ পেশ করা হলো।
জাতীয় কৃষি সমবায় ফেডারেশন জাপানের এবং সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষি সমবায় সংগঠন হিসেবে বিবেচিত। এর প্রধান দপ্তর টোকিওতে অবস্থিত। ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ থেকে এর যাত্রা। বর্তমানে এর বার্ষিক আয় ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কৃষি খামারগুলোর অর্থনৈতিক মান বৃদ্ধি করা, বাজারব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পাশ কাটিয়ে কৃষকদের জন্য পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষকদের জন্য বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উৎপাদনে নিয়োজিত মূলধন সংগ্রহে সহায়তা করা ওই সমবায় সংগঠনের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।
দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় কৃষি সমবায় ফেডারেশন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষি সমবায় সংগঠন হিসেবে পরিচিত। এর বার্ষিক আয় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট এর প্রতিষ্ঠা। এক হাজার ১৫৫ সমবায় সমিতি এই ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। এর সদস্য সংখ্যা ২.৪ মিলিয়ন। কৃষকদের উৎপাদনে ও বিপণনে সহায়তা দেওয়া এই সংগঠনটির প্রধান উদ্দেশ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যবসা সমবায় সংগঠন পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। এর বার্ষিক আয় ৩১.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজার ৪৫৫। কৃষকদের উৎপাদনে সহায়তা করা এবং নতুন প্রযুক্তি, বীজ, সার, কীটনাশক, জ্বালানি ইত্যাদি যথাসময়ে ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করা সংগঠনটির প্রধান দায়িত্ব। পৃথিবীব্যাপী সদস্যদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত করাও সংগঠনটির কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।
কৃষি সমবায় তথা দুগ্ধ সমবায়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড। সে দেশের ফন্টেরা সমবায় সংঘ লিমিটেড বিশ্বের একটি অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় হিসেবে বিবেচিত। এর বার্ষিক আয় ১৩.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সদস্যসংখ্যা ১০ হাজার ৫০০ দুগ্ধ খামারি। মোট বার্ষিক দুগ্ধ উৎপাদন দুই বিলিয়ন লিটার। এই সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুধ, পনির, মাখন, দই ও আইসক্রিম সরবরাহ করে থাকে।
ডেনমার্কে অবস্থিত আরলা ফুডস একটি বহুল পরিচিত খাদ্য সমবায়। এটি মূলত দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮০ সাল। ডেনমার্ক ও সুইডেনে ছড়িয়ে থাকা মোট ১১ হাজার ২০০ সদস্য নিয়ে এর অভিযাত্রা। মোট দুগ্ধ উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ১৩.৭ বিলিয়ন কিলোগ্রাম। বার্ষিক আয় ১৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের ১৫১টি দেশে সংগঠনটি দুধ, পনির, মাখন, ক্রিম ও মার্জারিন রপ্তানি করে থাকে। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য সংগঠনটিতে ৬০টি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা নিয়োজিত রয়েছে। ডেনমার্কের শতকরা ৯৫ ভাগ দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত।
ভারতে বহুল পরিচিত দুগ্ধ সমবায় সংগঠন আমুল ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গুজরাট সমবায় দুগ্ধ বিপণন ফেডারেশন লিমিটেড এই সংগঠনটির পরিচালনাকাজে নিয়োজিত। এতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সদস্যসংখ্যা ৩.৬ মিলিয়ন। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ১৩টি জেলার দুগ্ধ সমবায় ইউনিয়ন, যা ১৩ হাজার গ্রামে বিস্তৃত রয়েছে। ভারতের জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আমুল শ্বেত বিপ্লব ত্বরান্বিত করে দেশটিকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করেছে। এই সংগঠনটি প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য বাজারজাত করছে। এর বার্ষিক আয় সাত মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিডেট গ্রামীণ সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ সংগ্রহ, দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে এর অধীন প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সংখ্যা দুই হাজার ৫১৭ এবং ব্যক্তি সদস্যের সংখ্যা এক লাখ ১৭ হাজার ৭৫৮। এই সমিতির উৎপাদিত পণ্যের ব্র্যান্ড নাম মিল্ক ভিটা। তরল দুধের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি ঘি, মাখন, মিষ্টি ও টক দই, আইসক্রিম, ক্রিম, চকোলেট, লাবাং, রসগোল্লা, সন্দেশ, রসমালাই ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণন করে থাকে। এর বার্ষিক দুগ্ধ সংগ্রহের পরিমাণ ৪.৩২ কোটি লিটার। শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। বার্ষিক নিট লাভের পরিমাণ ১৮৫.৬৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশে বর্তমানে একটি পথিকৃৎ সমবায় সংগঠন হিসেবে কাজ করছে মিল্ক ভিটা।
বাংলাদেশ সমবায়ের এক উর্বর ভূমি। বর্তমানে এ দেশে ২৯ প্রকারের সমবায় সমিতি রয়েছে। মোট সমিতির সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এতে অংশগ্রহণকারী সদস্যের সংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি। তাঁদের একটি বড় অংশ কৃষি সমবায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কৃষিপণ্যের উৎপাদন করছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের নাগপাশ এড়িয়ে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছে। সমবায়ের মাধ্যমে তারা উন্নত বীজ, সার, সেচ ও কৃষি যন্ত্রায়নের ব্যবস্থা করছে। সমবায়ী কৃষকরা মিলিত হয়ে মাঠের ফসল সংগ্রহ করছেন, মাড়াই, ঝাড়াই ও সংরক্ষণ করছেন। বন্যা, খরা ও তীব্র শৈত্য প্রবাহের সময় তাঁরা একসঙ্গে লড়ছেন। একসঙ্গেই তাঁরা মোকাবেলা করছেন সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈপরীত্যকে। বর্তমানে দেশের কৃষিব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও গ্রামীণ জীবন উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হচ্ছে সমবায়।
বাংলাদেশে এখন প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। আরো উৎপাদিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণে মাছ, ফলমূল ও পশুপাখি। এতে সমবায়ী কৃষকদের বড় অবদান রয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এর জন্য দেশের খাদ্য ও কৃষিপণ্যের উৎপাদন বছরে গড়ে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে বাড়িয়ে যেতে হবে। দেশের শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির পক্ষে এত দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে যাওয়া খুবই দুষ্কর। এর জন্য দরকার তাঁদের সংগঠিত করা। আর্থিক ও সামাজিকভাবে তাঁদের ক্ষমতায়ন করা। সমবায়ের মাধ্যমেই তা সম্ভব হতে পারে। এ লক্ষ্যে সমবায় আন্দোলনকে আরো জোরদার করা দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা বাড়ানো দরকার দেশের সমবায়ী কৃষকদের জন্য। এতে কৃষি সমবায়ের ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে। সমৃদ্ধিশালী হবে দেশের অর্থনীতি। তবে দেশের সমবায়ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করার জন্য এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার। একে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত রাখা দরকার।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ