কারও কাছে পুণ্যভূমি আবার কেউ বলেন প্রকৃতিকন্যা। প্রবাসী আধিক্যের কারণে দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবেও রয়েছে খ্যাতি। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ৩৬০ আউলিয়ার পদচারণধন্য প্রাচীন জনপদ সিলেটের প্রতি সারা দেশের মানুষের রয়েছে আলাদা টান। যে কারণে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসে সিলেটে। কারও গন্তব্য হজরত শাহজালাল (রহ.)সহ বিভিন্ন ওলি-আউলিয়ার মাজার, আবার কেউ ছোটেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। গন্তব্য যা-ই হোক, সিলেটের মাটিতে পা রেখেই অতিথিদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে। যে ভোগান্তি সিলেটবাসীর নিত্যদিনের। জঞ্জালঘেরা সিলেট নগরীর এ ভোগান্তি দেখারও যেন কেউ নেই।
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যায় নগরীর প্রায় অর্ধেক রাস্তা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর সড়ক মেরামতের জন্য সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বহুবার চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ মেলেনি। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের শুরুর দিকে হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ মিললেও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটি বাতিল করা হয়েছে। গত এক বছরে সিলেট নগরীর খানাখন্দে ভরা কোনো সড়কেই সংস্কারের প্রলেপ লাগেনি। ফলে দিনদিন সড়কে খানাখন্দের ব্যাপ্তি বাড়ছে। বাইরে থেকে কোনো অতিথি ট্রেন বা বাসে সিলেট পৌঁছেই পা রাখতে হচ্ছে এ ক্ষতবিক্ষত সড়কে। যোগাযোগ ভোগান্তি নিয়েই শেষ করতে হয় তাদের সফর।
সিলেট নগরীর সবচেয়ে বড় ভোগান্তির নাম হকার। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর পাশের ফুটপাত অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে হকাররা। বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, রিকাবিবাজার, মদিনা মার্কেটসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও ফুটপাত পরিণত হয়েছে হকার মার্কেটে। এতে বেড়েছে যানজট। যানবাহন ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলারও সুযোগ নেই দখল হয়ে যাওয়া ফুটপাতের কারণে। নানান পন্থায়, নানান ব্যানারে সিলেটবাসী দিনের পর দিন ফুটপাত ও সড়ক হকারমুক্ত করার দাবি জানিয়ে এলেও সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও জেলা প্রশাসন কেউই যথোপযুক্ত উদ্যোগ নেয়নি। মাঝখানে সিসিক ও মেট্রোপলিটন পুলিশের যৌথ উদ্যোগে নগর ভবন লাগোয়া লালদিঘি মাঠে হকারদের অস্থায়ীভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর হকাররা ফের চলে আসে সড়ক ও ফুটপাতে। নগরীর সড়কের মতো অবস্থা সুরমা নদীর ওপর ক্বিনব্রিজেরও। পুরো ব্রিজ পরিণত হয়েছে ভাসমান মার্কেটে। মাছ-সবজি থেকে শুরু করে গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় সব পণ্যই মেলে ঐতিহ্যবাহী এই সেতুতে।
অন্যদিকে সিলেট নগরীতে সম্প্রতি বেড়েছে চুরি-ছিনতাই। বিশেষ করে সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়ে অনেকে হারাচ্ছেন সর্বস্ব। কোথাও কোথাও ছিনতাইকারীদের হামলারও শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও কর্তৃপক্ষ নীরব। গত মাসের মাঝামাঝি জেলা প্রশাসক হিসেবে সিলেটে যোগদান করেছেন র্যাবের সাবেক আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। সাদাপাথরকাণ্ডে যখন সিলেট অস্থির, তখন দায়িত্ব নেন তিনি। চেয়ারে বসেই তিনি সাদাপাথর উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেন। এতে সাদাপাথর আগের রূপে ফিরতে শুরু করে। চোরাই পাথর উদ্ধার করে প্রতিস্থাপনের মতো দুঃসাধ্য কাজ ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। রোগীদের ভোগান্তি আর কর্তৃপক্ষের অনিয়ম দেখতে তিনি পরিদর্শন করেন ওসমানী হাসপাতাল। অভিভাবকশূন্য ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল চালুর উদ্যোগ নেওয়ারও আশ্বাস দেন। করিৎকর্মা এই প্রশাসক পেয়ে সিলেটের মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। কয়েক দিন আগে তিনি ঘোষণা দেন ক্বিনব্রিজকে হকারমুক্ত করে পুরোপুরি পদচারী সেতুতে পরিণত করার। গোটা নগরীর ফ্টুপাতই হকারমুক্ত হওয়া উচিত।
এদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব নিয়েছেন আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী পিপিএম। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি সিলেটকে নিরাপদ স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা বলেছেন। সেটা কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে তাঁর সদিচ্ছাটা স্পষ্ট।
প্রশাসনের এই দুই কর্মকর্তাকে নতুন ঘিরে সিলেটবাসীর স্বপ্নের বিস্তৃতি ঘটছে। তাঁরা চান পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক এই পুণ্যভূমি নগরবাসী এবং পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের জন্য প্রশান্তিময়, নিরাপদ হোক।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী