কারবালার কিছুদিন পরের ঘটনা।
জলিলে কদর সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) মদিনার মসজিদে ওয়াজ করছিলেন। ওয়াজ শেষে শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘শরিয়তে মশা হত্যা জায়েজ না হারাম?’ ইবনে ওমর পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ প্রশ্নকারী বললেন, ‘আমি কুফা থেকে এসেছি।’ ইবনে ওমর শ্রোতাদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘ওহে! তোমরা এই গর্দভের অবস্থা দেখো! তারা নবীর নাতিকে হত্যা করে এসে মশা হত্যার মাসয়ালা জানতে চাচ্ছে’ (বুখারি, হাদিস ৩৭৫৩; জামে তিরমিজি, হাদিস ৩৭৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৫৯৯৪)!
বুখারির এই হাদিসটি যেন আজও প্রাসঙ্গিক। বরং এখন এর প্রাসঙ্গিকতা আরও ব্যাপক হয়েছে। হাদিসটির সারমর্ম হলো, মহানবী (সা.)-এর নাতিকে হত্যার মতো গুরুতর জঘন্য একটি ঘটনা এড়িয়ে গিয়ে কুফাবাসীর কাছে মশা হত্যার বিষয়টি আলোচনার বিষয় পরিণত হয়েছে। যে কারণে ইবনে ওমর ফতোয়া না দিয়ে আফসোস করেছেন। ইবনে ওমর ছিলেন মদিনার বিশিষ্ট সাহাবিদের একজন। তিনি ওই সময় জ্ঞান প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন। জ্ঞান প্রচারকের প্রধান দায়িত্ব হলো জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন জিজ্ঞাসাকারীর মন কেন্দ্রীয় বিষয় থেকে ছিটকে পড়েছে তখন তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ধিক্কার দিলেন। আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালেও একই ধিক্কার দিতেন ইবনে ওমর (রা.)। বিশ্বের নানা প্রান্তে শত শত বছর ধরে মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার। কেউ শারীরিক নির্যাতনের শিকার আর কেউ মানসিক দাসত্বের যন্ত্রণায় দিশাহারা। এই যখন বিশ্ব মুসলমানদের অবস্থা তখন আমাদের উম্মাহর বড় অংশই দীনের ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এমনভাবে দ্বন্দ্বের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পড়েছে, যা থেকে বের হওয়ার কোনো চেষ্টাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নবীজি (সা.)-এর নুর না মাটি, মিলাদ দাঁড়িয়ে না বসে, নামাজে হাত কোথায় তুলবে, কতবার তুলবে, কোথায় বাঁধবে, আমিন জোরে না আস্তে, মোনাজাত কীভাবে দেবে, তারাবি কয় রাকাত- এমন হাজারো মীমাংসিত প্রশ্ন বারবার ঘুরে-ফিরে আলোচনায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এসব আলোচনা দোষণীয় নয়। উম্মাহর বিদগ্ধ আলেমরা এ ব্যাপারে শত শত গ্রন্থ লিখেছেন এও ঠিক। কিন্তু গত কয়েক শতাব্দী মুসলমানরা যেভাবে কেন্দ্রীয় বিষয় বাদ দিয়ে ছোটখাটো বিষয়ে ডুবে গেছেন তার ফলে মুসলিম বিশ্ব আজ কোমরভাঙা জাতিতে পরিণত হয়েছে। তারা পৃথিবীর কোথাও আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াতে গেলে দেখে পায়ের নখ আর হাতের নখের পেছনে এত এত শ্রম, গুরুত্ব, মনোযোগ নষ্ট করেছে যে, কখন একটি একটি করে মেরুদণ্ডের সবকটি হাড় ক্ষয় হয়ে মিশে গেছে তা টেরও পায়নি। যার বাস্তব সাক্ষী হলো গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের পরও মুসলিম বিশ্বের নীরবতা ও প্রতিবাদহীন সুখে জীবনযাপনের নির্লজ্জ দৃশ্য। ২০০০ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত ওআইসির নবম ইসলামি সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এক জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা ড. মাহাথির মোহাম্মদ। আড়াই দশক আগে তিনি দরদি ভাষায় বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনের মুসলমানদের প্রতি ইসরায়েলের নির্মমতার চেয়েও বেশি বেদনাদায়ক মুসলিম বিশ্বের নীরবতা। জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্বকারী এক- তৃতীংয়াংশেরও বেশি মুসলমান দেশ অসহায়ভাবে ইসরায়েল কর্তৃক স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের অব্যাহত হত্যাযজ্ঞ চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করছে না। মুসলিম দেশগুলোর জন্য এ এক চরম লজ্জা যে, ইসরায়েলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই তারা নিতে পারছে না। ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষদেরই হত্যা করেনি বরং মুসলমানদের শক্তি-সামর্থ্যরে অসহায়ত্বকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ যে মুসলিম বিশ্বের জন্য কত লজ্জার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’ (ইসলাম অ্যান্ড দি মুসলিম উম্মাহ, ১৩ পৃষ্ঠা।) দুই যুগ আগে ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরায়েলের আগ্রাসন যেমন ছিল এখন তা বেড়ে আরও কয়েকগুণ হয়েছে। নারী-শিশুরা ভয়াবহভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। জীবিতরা এক মুঠো খাবারের জন্য ছটফট করছে। এমন পরিস্থিতিতেও মুসলিম বিশ্বের ঘুম ভাঙেনি। আজও আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় ঠিক করতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খতিবে আজম মুফতি আবদুল মালেক হাফেজাহুল্লাহর একটি বক্তব্য চোখে পড়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এখন সৌদি আরবও অক্ষম, মিসরও অক্ষম, জর্ডানও অক্ষম। মধ্যপ্রাচ্যের সবাই অক্ষম। কেউ ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। আসলে কেউই মাজুর নয়। বরং প্রত্যেকেই সামরিক শক্তিতে পূর্ণ সক্ষম। অক্ষমতা শুধু ইমানের।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট
www.selimazadi.com