বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনা এমন এক শাসকের প্রতীক, যিনি ক্ষমতা রক্ষার জন্য শুধু আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করেননি, বরং রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে। নিজের অপরাধ আড়াল ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তিনি বারবার বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের ওপর দায় চাপিয়ে গেছেন। তার শাসনকালেই ‘অপরাধ ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি’ রূপ নেয় রাষ্ট্রীয় নীতিতে- যেখানে সহিংসতা, গুম-খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, মিথ্যা মামলা ও প্রোপাগান্ডাই ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রধান কৌশল।
শেখ হাসিনা নিজে নানা অপরাধ সংঘটিত করে সেই দায় বিরোধীদের ঘাড়ে চাপানোর এক নিপুণ কৌশল অবলম্বন করতেন। নিচে তার সেই অপরাধ-প্ররোচনার কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হলো :
১. শেখ হাসিনার অপরাধে প্ররোচনা : ট্রাইব্যুনালের নথিতে ভয়াবহ প্রমাণ : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা সাম্প্রতিক অডিও এবং ভিডিও ডকুমেন্টসে দেখা যায়, শেখ হাসিনা নিজেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিতেন আন্দোলনকারীদের ওপর দমন অভিযান চালাতে, এমনকি তাদের ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করেন এবং গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনায় দলীয় সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেন। প্রসিকিউটরদের ভাষায়, দীর্ঘ ১৫ বছরে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় ক্যাডারদের দানবে পরিণত করে, জনগণের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করেছেন।
২. রাজনৈতিক ফায়দার জন্য নিজেরাই অপরাধ সৃষ্টি : ২০০৪ সালের ৪ জুন ঢাকায় শেরাটন হোটেলের সামনে বিআরটিসির বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয়। পরদিন শেখ হাসিনা রংপুরে জনসভায় সেই হত্যার দায় চাপান বিএনপি-জামায়াতের ওপর। তিনি বলেন, ‘মানুষের গায়ে আগুন দিয়ে যারা পোড়ায়, তারা মানুষ নয়, দানব।’
কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য- এটি ছিল আওয়ামী যুবলীগ নেতাদের পরিকল্পিত অপারেশন।
ওয়ান ইলেভেন সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হওয়া শেখ সেলিম জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন যে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমের নির্দেশেই সেই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল। এমনকি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মইদুল ইসলাম একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিএনপির ওপর দায় চাপাতে শাহবাগে বাসে আগুন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা পঙ্কজ দেবনাথ। আগুন দিয়েছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই।’
৩. ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : ওয়ান ইলেভেনের পথরেখা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনা শুধু একটি রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা নয়, এটি ছিল শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ ক্ষমতায় ফেরার কৌশলের সূচনা। সমাবেশস্থল পরিবর্তন, আগাম সতর্কতা উপেক্ষা ও ঘটনার পর পরিকল্পিত অপপ্রচার- সবকিছুই ইঙ্গিত দেয় যে এটি ছিল একটি সাজানো চক্রান্ত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তখন প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশ মূলত “মুক্তাঙ্গনে” হওয়ার কথা ছিল। লিখিত অনুমতিও ছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন ও পুলিশের। এমনকি সংবাদপত্রেও সেই ভেন্যুর নামেই খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমাবেশের দিন কাউকে না জানিয়ে সমাবেশ শুরুর দুই ঘণ্টা আগে হঠাৎ করে ভেন্যু পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নেওয়া হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন- কে, কবে এবং কী কারণে এই সিদ্ধান্ত নিল? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কি জানানো হয়েছিল?’
তারেক রহমান আরও বলেন, ‘একটি জাতীয় দৈনিকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে হামলাকারী আবু জান্দাল ও কাজল আগের দিনই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিদর্শন করেছিল। তাহলে তারা আগেভাগে কীভাবে জানল সমাবেশ “মুক্তাঙ্গনে” নয়, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতেই হবে? কে তাদের এই তথ্য জানাল?’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন নিজেই বলেছেন, তারা ২১ আগস্ট হামলার আশঙ্কার কথা দুই দিন আগেই জেনেছিলেন এবং শেখ হাসিনাকে জানিয়েছিলেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ তখন কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? পুলিশকে বা প্রশাসনকে জানানো হয়েছিল কি?’
এসব প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তদন্তে দেখা গেছে, পুলিশ বা প্রশাসনকে কোনো সতর্কবার্তাই দেওয়া হয়নি। ২১ আগস্টের হামলা ছিল সেই বড় ষড়যন্ত্রেরই অংশ, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপিকে কোণঠাসা করা হয় এবং ওয়ান ইলেভেনের পটভূমি তৈরি করা হয়।
তারেক রহমান যথার্থই বলেছিলেন- ‘একুশে আগস্ট আর ওয়ান ইলেভেন একই সূত্রে গাঁথা। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ধ্বংসের মহড়া শুরু হয়েছিল একুশে আগস্ট থেকেই।’
শেখ হাসিনা নিজের দলের নেতা-কর্মীদের রক্তকেই ব্যবহার করেছেন ক্ষমতায় ফেরার সিঁড়ি হিসেবে। রাজনীতিকে রূপ দিয়েছেন, প্রতিশোধের যন্ত্রে, যেখানে মানবিকতা পরাজিত হয়েছে কৌশল ও ষড়যন্ত্রের কাছে।
৪. চৌদ্দগ্রামে বাসে আগুন : সাজানো নাটকের আরেক অধ্যায় ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চৌদ্দগ্রামে বাসে দেওয়া আগুনে ৮ জন নিহত হয়। সরকারি প্রচারণা বিএনপির বিরুদ্ধে গেলেও পরে অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়, ঘটনাটির পরিকল্পনা হয়েছিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের গুলশানের বাসায়। স্থানীয় আওয়ামী নেতা আশিকুন্নবী বাপ্পি গানপাউডার সরবরাহ ও বাস্তবায়নে সরাসরি ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ ওঠে।
বিএনপির সাবেক এমপি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী কুমিল্লা আইনজীবী সমিতিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাসে পেট্রোলবোমা নয়, গানপাউডার দিয়েই আগুন লাগানো হয়েছিল এবং এতে আওয়ামী লীগ নেতারাই জড়িত।’
৫. পিলখানা হত্যাযজ্ঞ : রাষ্ট্রবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র : মেজর (অব.) মহসীন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় আর্মি অ্যাভিয়েশনে হেড অব অ্যাডমিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায়ই তাকে বরখাস্ত করা হয়। ‘আমার দেশ আমার গর্ব’ নামে একটি পেজে মেজর (অব.) মহসীন লিখেছেন, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করার এক গভীর ষড়যন্ত্র।’
তিনি আরও লেখেন, ‘যেসব অফিসার নিহত অফিসারদের পোস্টমর্টেম দাবি করেছিলেন, তাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেকের শরীরে ভারতীয় বুলেট পাওয়া গিয়েছিল, সব ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।’
বিশ্লেষকরা একমত, মূল পরিকল্পনা আসে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা (RAW)) থেকে, আর শেখ হাসিনার সরকার ছিল তার বাস্তবায়নকারী। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ভেঙে দেওয়া, বিডিআর বাহিনী ধ্বংস এবং দেশের প্রতিরক্ষা কাঠামো দুর্বল করা। ফলাফল ৫৭ সেনা অফিসারসহ ৭৭ জন নিহত। সেনাবাহিনীতে চরম ক্ষোভ। আর সরকার রিপোর্ট ধামাচাপা দেয়।
মূলত পিলখানা হত্যাকাণ্ড ছিল ভারতের ‘র’ ও শেখ হাসিনার যৌথ পরিকল্পনায় পরিচালিত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা।
৬. আগুন ও সহিংসতার রাজনীতি : দায় চাপানোর নীতি : বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী যথার্থই বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ইতিহাসজুড়ে নিজেরাই আগুন লাগিয়েছে, হত্যা করেছে, তারপর দায় চাপিয়েছে বিএনপির ওপর।’
২০১৩-১৫ সালের আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ফেনী ও মাতুয়াইলের অগ্নিকাণ্ড- সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জাতীয় সংসদের বিএনপিদলীয় সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘নিজেরা আগুন দেয়, নিজেরা হত্যা করে, তারপর নাটক সাজিয়ে বিএনপির নাম ব্যবহার করে।’
৭. বিচার ও দায় এড়ানোর নতুন ষড়যন্ত্র : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই তিন শতাধিক অভিযোগ গৃহীত হয়েছে এবং রায় ঘোষণার তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০২৫। রায় ঘোষণার আগেই ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে নাশকতা ও সহিংসতা ছড়িয়ে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে, গাজীপুরে ঝুটের গোডাউনে, মোহাম্মদপুরের ভবনে এবং আরও নানা স্থানে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড এই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
একই সময়ে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত এমপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহসহ একাধিক নেতা গুলিবিদ্ধ হন- যা দেশ অস্থিতিশীল করার নীলনকশারই প্রমাণ।
এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা ভারতের মদতে আবারও দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ৫ নভেম্বর এক ভিডিও বার্তায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক ‘১৩ নভেম্বর লকডাউন’-এর ঘোষণা দিয়েছেন। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো বড় ধরনের কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে নানক বলেন, ‘১৩ নভেম্বরকে সামনে রেখে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। ঢাকায় আমরা ১৩ নভেম্বর লকডাউন দিয়েছি। সকাল-সন্ধ্যা লকডাউন।’ জাহাঙ্গীর কবির নানক আরও বলেন, ১০, ১১, ১২ নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল এবং ১৩ নভেম্বর যেন রাজধানী ঢাকা শহর আমাদের দখলে থাকে, জয় বাংলার দখলে থাকে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতের ঘোষণা, যার লক্ষ্য রায় ঘোষণাকে ঘিরে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা তৈরি করা।
শেখ হাসিনার রায় ঘিরে জাহাঙ্গীর কবির নানকের এই ভিডিও প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ঢাকা শহর এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝটিকা মিছিল করেছে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে বড় আকারের নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জনরোষে বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবারও ভারতীয় সহায়তায় দেশে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে চায়- প্রশাসনে তাদের অনুগতদের দিয়ে ঘটাতে চায়- দাঙ্গা, আগুন, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আর ঠিক সেই সময়ই সক্রিয় হয়েছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায়। ভারতের ছত্রছায়ায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আবারও সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস ও অস্থিতিশীলতার মাধ্যমে জাতিকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আওয়ামী লীগ একটি নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর রাজনৈতিক সংগঠন, যাদের লক্ষ্য শুধু ক্ষমতা দখল ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা। নিজেদের স্বার্থে তারা যে কোনো অন্যায়, অপকর্ম কিংবা চক্রান্ত করতেও পিছপা হয় না। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের পাশাপাশি দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, প্রশাসন ও সর্বস্তরের জনগণকে এখনই সতর্ক, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে- যেন কোনো ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় শান্তিকে বিপন্ন করতে না পারে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক- আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল