সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহপাকের জন্য। অসংখ্য সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের ওপর। হে মুসলিম ভাইবোনেরা, আসুন আল্লাহকে ভয় করি, কেননা আল্লাহভীতি হলো তাঁর সন্তুষ্টি লাভ এবং শাস্তির যন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভের সবচেয়ে বড় উপকরণ। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন (সুরা ত্বীন-৪) এজন্য আমরা যেন আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করি অর্থাৎ তার সন্তুষ্টিমূলক কার্যাবলি সম্পাদন ও নিষেধ করা বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে রেহাই পাই। মানুষ হিসেবে আমরা জানি কি! সবচেয়ে পেরেশানির মুহূর্ত কোনটি? সবচেয়ে ভয়ভীতির সময় কোনটি? সর্বাধিক উৎকণ্ঠা, সংকীর্ণতা, দুশ্চিন্তার মুহূর্ত কোনটি? সেটি হলো সেই সময় যখন দৃষ্টিশক্তি লক্ষ্যহীন হয়ে পড়বে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে এবং কঠিন সব বিষয় অবলোকন করে ভয়ে মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঁপতে থাকবে। আর এমন সব অবস্থার সম্মুখীন হবে, যাতে শরীর ফেটে যাবে। সেই মুহূর্তটি জাহান্নামের ওপর দিয়ে সিরাত (ফারসি ভাষায় পুলসিরাত) পার হওয়ার সময়টুকু। সেই সিরাত অতিক্রমকারীদের জন্য রয়েছে মহাপ্রাপ্তি, চিরস্থায়ী নেয়ামত জান্নাত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারা এই নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে থাকবে (ইবরাহিম-২৩)। আর যারা কুফরি করে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি (আল ইমরান-১২)। আল্লাহ আমাদের নবীকে (সা.) বলেছেন, বলে দাও কিয়ামত অতি কাছে (আহজাব-৬৩) আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা এটিকে দূরবর্তী দেখ, কিন্তু না এটি অতি নিকটবর্তী। তিনি আরও বলেন, কিয়ামতের বিষয় তো একটি চোখের পলক বা তার চেয়ে নিকটবর্তী ভিন্ন কিছু নয় (নাহল-৭৭)। মানুষের হিসাব গ্রহণের সময় ঘনিয়ে এসেছে অথচ তারা গাফিলতিতে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে (আম্বিয়া-১)। দুনিয়ার সংকোচন ও অবসান কত দ্রুত। কেননা আল্লাহ এটিকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই প্রত্যেককে এখানে আমলের প্রতিদান লাভের জন্য কাজ করে যাওয়া আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি মন্দ আমলকারীদের যেমন তাদের কর্মফল দিতে পারেন তেমনি সৎ আমলকারীদেরও উত্তম প্রতিদান দিতে পারেন।
মানুষের সামনে তুলনাহীন ওই মুহূর্ত থেকে পলায়নের কোনো পথ থাকবে না। আল্লাহতায়ালা জাহান্নামের পৃষ্ঠে স্থাপিত পুলসিরাত সম্পর্কে বলেন, আর তোমাদের প্রত্যেককেই তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে হবে, এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে একটি অনিবার্য সিদ্ধান্ত (মারিয়াম-৭১)। আর আমি তাদের উদ্ধার করব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছিল আর জালিমদের সেখানে নতজানু অবস্থায় ফেলে রাখব (মারিয়াম-৭২)। এটি জাহান্নামের ওপর দিয়ে পুলসিরাত অতিক্রমের মুহূর্ত, যার ভয়ে সাহাবায়ে কেরামদের অন্তর এবং তাদের পথ অবলম্বনকারী পরবর্তীদের অন্তরও আল্লাহর ভয়ে পূর্ণ হয়ে থাকত।
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রসুল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা সব মানুষকে একত্র করবেন। সে সময় মোমিনরা উঠে দাঁড়াবে। একপর্যায়ে জান্নাতকে তাদের কাছে আনা হলে তখন সবাই আদম (আ.)-এর কাছে এসে বলবে- আমাদের জন্য জান্নাত খুলে দেওয়ার প্রার্থনা করুন। আদম (আ.) বলবেন, তোমাদের এই পিতার ভুলের কারণেই তো তোমাদের জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তোমরা নূহ (আ.) কাছে যাও। তার কাছে গেলে তিনি বলবেন ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি (আমি তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত)। তোমরা ইব্রাহিম (আ.)-এর কাছে যাও। তার কাছে গেলে তিনিও অনুরূপ বাক্য উচ্চারণ করে মুসা (আ.)-এর কাছে যেতে বলবেন। মুসা (আ.) ও অনুরূপ বাক্য বলে ঈশা (আ.)-এর কাছে যেতে বলবেন। ঈশা (আ.)-এর কাছে আরজি পেশ করলে তিনিও অনুরূপ শব্দ উচ্চারণ করে আখেরি জামানার নবী এবং নবীকুলের শিরোমণি মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যেতে বলবেন। অবশেষে মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে এলে তিনি মহান রবের কাছে সিজদারত হয়ে তাঁর প্রশংসা করলে, তিনি বলবেন হে মুহাম্মদ! মাথা উত্তোলন করুন। আপনি যা চান তাই দেওয়া হবে, আপনি সুপারিশ করুন, আপনার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। অতঃপর জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। তখন মোমিনদের প্রথম দলটি বিদ্যুৎগতিতে পুলসিরাত পার হবে। পরবর্তী দলগুলো যথাক্রমে বায়ুর গতিতে, পাখির গতিতে, তার পরবর্তীরা লম্বা দৌড়ের গতিতে এবং অন্যরা স্ব-স্ব আমল অনুযায়ী তা অতিক্রম করবে (বুখারি মুসলিম)। তখন নবী (সা.) পুলসিরাতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই দোয়া করতে থাকবেন ‘হে আল্লাহ! এদের নিরাপদে পৌঁছে দিন (দুইবার)।’ এভাবে মানুষের আমল তাদের চলতে অক্ষম করে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা এটি অতিক্রম করতে থাকবে। শেষে এক ব্যক্তিকে দেখা যাবে সে হামাগুড়ি দিয়ে সেটি অতিক্রম করছে। অন্য হাদিসে এসেছে কিছু মানুষ পুলসিরাত থেকে জাহান্নামে পড়ে যাবে এবং অন্যান্য জাহান্নামবাসীকে টেনে নিয়ে দলে দলে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। কিয়ামত অতি সন্নিকটে, তাই সময় থাকতে আমরা প্রত্যেকেই তওবাহ করে আল্লাহ অভিমুখী হই এবং সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎকর্ম পরিহার করে রসুল (সা.)-এর নির্দেশনা অনুসরণে আমল করে পুলসিরাত পার হওয়ার জন্য তাঁর সাফায়াত লাভের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তওফিক দান করুন- আমিন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট