নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে বিজয়ী হয়েছেন জোহরান মামদানি। বিভিন্ন জরিপ এবং জনমতের ভিত্তিতে এটা একপ্রকার ধারণা ছিল যে জোহরান মামদানি হয়তো জিতবেন। জোহরান মামদানি জিতবেন এই অনুমানের সপক্ষে যেমন যুক্তিতর্ক এবং আলামত ছিল তেমনি হারেরও একটা শঙ্কা ছিল এবং এই শঙ্কার পেছনে বিভিন্ন কার্যকারণ ছিল। সবকিছু ছাপিয়ে এখন আলোচনার বিষয় হলো জোহরান মামদানির বিজয় এবং এই বিজয়ের ধারাবাহিকতায় আমেরিকা তথা বৈশ্বিক রাজনীতির একটা সম্ভাব্য পরিবর্তন। ইলেকশনে জোহরান মামদানির এটাই প্রথম বিজয় নয়। তিনি ২০২০ সালে নিউইয়র্ক স্টেট এসেম্বলির ৩৬ নম্বর জেলার নির্বাচনে পাঁচ মেয়াদের ইনকাম্বেন্টকে পরাজিত করেন। কিন্তু তখন তিনি এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেননি বা পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে পারেননি। মামদানি মূল আলোচনায় আসেন ২০২৫ সালে যখন তিনি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে অংশগ্রহণ করে বড় জয় অর্জন করেন। এটা একপ্রকার অপ্রত্যাশিত জয় ছিল।
মামদানি বার্নি স্যান্ডার্স বা আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজের মতো প্রগতিশীল ধারা থেকে উঠে আসা তথাকথিত ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট ধারার প্রতিনিধি। নিউইয়র্ক ডেমোক্রেটিক পার্টির মূলধারার প্রার্থীরা সাধারণত ইউনিয়ন, বড় দাতা গোষ্ঠী ও স্থানীয় পার্টি কাঠামোর সমর্থন পান। কিন্তু মামদানি এসব প্রাতিষ্ঠানিক মূলধারার বাইরে থেকে উঠে এসেছেন। মামদানি জন্মেছেন উগান্ডায়, পরিবার ভারতীয় বংশো™ূ¢ত, বড় হয়েছেন আমেরিকায় এবং মুসলিম পরিচয়ে রাজনীতিতে এসেছেন। এই বহুজাতিক, অভিবাসী পরিচয় সাধারণ নিউইয়র্ক ডেমোক্রেটিক রাজনীতির জন্য একসময় ছিল অস্বাভাবিক ও কম গ্রহণযোগ্য। পাশাপাশি মামদানি প্রকাশ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রো-প্যালেস্টাইন অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু যদি নিউইয়র্কে আসে তবে মেয়র নির্বাচিত হলে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করবেন। তাঁর এই অবস্থানের কারণে অনেক ইহুদি-আমেরিকান দাতারা তাঁর বিরোধিতা করেন। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে বিজয়ের পর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত আরও অনেক ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। প্রাইমারিতে জয়ী হওয়ার পর সাধারণত পার্টি বিজয়ী প্রার্থীকে অর্থ, জনবল ও মিডিয়া সমর্থন দেয়। কিন্তু মামদানির ক্ষেত্রে পার্টি অনেকটা নীরব থেকেছে। ফলে তাঁকে তহবিল সংগ্রহে নিজের স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাঁর তহবিলের উৎস ছিল সাধারণ মানুষ। অবশ্য এই তহবিল সংগ্রহ তাঁকে সাধারণ মানুষের আরও কাছকাছি নিয়ে গেছে।
রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, কিছু স্থানীয় ও ডানপন্থি মিডিয়া তাঁর বিপক্ষে প্রচারণা চালায় যে মামদানি নিউইয়র্কের ভাড়া নীতি, পুলিশ বাজেট ও রাজ্য কর কাঠামো ধ্বংস করতে চান। তাঁর ভাড়া নিয়ন্ত্রণ প্রস্তাবকে বলা হয় ‘অর্থনীতিবিরোধী’ রেডিক্যাল চিন্তা। এর বিপরীতে মামদানি জবাব দেন- যদি বাসস্থান, চিকিৎসা এবং সম্মানের জন্য যুদ্ধ করাকে রেডিক্যাল বলা হয় তবে আমি একজন গর্বিত রেডিক্যাল। এই বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা উল্টো বাড়িয়ে দেয়। ইসরায়েল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র- এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কিছু প্রো-ইসরায়েল সংগঠন প্রপাগান্ডা ছড়াতে থাকে যে তিনি ভোটারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন যা ইহুদি ভোটারদের দূরে সরিয়ে দেবে। মামদানির প্রো-প্যালেস্টাইন অবস্থান এবং ইসরায়েলবিরোধী নীতির কারণে তাঁকে শুধু রিপাবলিকানদের নয়, নিজ দলের মধ্যেও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি অবস্থান পরিবর্তন না করে সরাসরি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ন্যায়বিচারের সঙ্গে ইহুদিদের নিরাপত্তার কোনো বিরোধ নেই। তাঁর পরিষ্কার চিন্তা এবং দৃঢ় অবস্থানের জন্যই হয়তো শেষের দিকে এসে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদি ভোটার তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে। স্থানীয় পার্টি অফিস অনেক সময় তাঁর প্রচারপত্র বিলি করেনি, কিছু ইউনিয়ন (যেমন পুলিশ ইউনিয়ন বা রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশন) তাঁকে সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এই ধরনের নীরব বয়কট রাজনৈতিকভাবে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে মামদানি সফল হয়েছেন ইশতেহারে সাধারণ মানুষকেন্দ্রিক বিভিন্ন নীতি যুক্ত করে এবং বিবিধ সৃষ্টিশীল উপায়ে সেসব নীতির সপক্ষে প্রচারণা চালানোর মধ্য দিয়ে। পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিকভাবে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো থেকে সরে না গিয়ে দৃঢ়ভাবে সেগুলোর সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। এলিট অলিগার্ক শ্রেণির বিপরীতে তাঁর এই সাধারণ বান্ধবনীতি এবং তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি দৃঢ় অবস্থান তাঁকে শেষ পর্যন্ত জয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীরভাবে সাড়া ফেলেছিল বলেই সব বাধা সত্ত্বেও মামদানি বেশ বড় ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। একজন মুসলিম, অভিবাসী, প্রো-প্যালেস্টাইন প্রার্থী মূলধারার বিরোধিতা পেরিয়ে বিজয়ী হলেন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর যেমন একটা গভীর প্রভাব আছে তেমনি তার বৈশ্বিক প্রভাবও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের ক্ষেত্রে তা ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক। মামদানি ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক থেকে সমগ্র আমেরিকা হয়ে বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। আমেরিকা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও তা হলো আমেরিকার ধনবান তথা অলিগার্ক শ্রেণির গণতন্ত্র। মামদানি সেই ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের মধ্য থেকে সেই ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে একত্র করেছেন খুব সফলভাবে। ট্রাম্প যেখানে এলিটদের সুবিধা নিশ্চিতের পাশাপাশি ক্ষমতাকে একটা রাজতন্ত্রের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেখানে মামদানির মতো সাধারণ জনবান্ধববিরুদ্ধ স্রোতের বিজয় নিশ্চিতভাবেই আমেরিকার রাজনীতির একটা প্যারাডাইম শিফট। পাশাপাশি এত দিন আমেরিকার রাজনীতিতে একটা প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে ইসরায়েলের বিরোধিতা করে আমেরিকায় ভোটে জেতা একপ্রকার অসম্ভব। সেই ধারণাকে মামদানি পরাজিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, অনেক ইহুদি ভোটারকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে ইসরায়েলের বর্বতার বিরুদ্ধে বলা মানে ইহুদিদের বিপক্ষে বলা নয়। সাধারণ ইহুদি জনগোষ্ঠীও বুঝতে শুরু করেছে যে ইসরায়েলের বর্বরতা আদতে তাদের বিশ্বের সাধারণ শান্তিকামী মানুষের কাছে হেয় করছে। তারা নিজেরাও ইসরায়েলের বর্বরতার বিষয়ে সচেতন হচ্ছে এবং এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। ইহুদি মানেই ইসরায়েল কিংবা ইসরায়েল মানেই ইহুদি এই চিন্তার দিন শেষ হয়ে আসছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র মূলত টিকে আছে আমেরিকার সমর্থনের ছত্রছায়ায়। মামদানির মতো তরুণ মানবিক রাজনীতিবিদদের উত্থানের অর্থ হলো ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার অন্ধ সমর্থনের সুযোগ সংকুচিত হওয়া। সুতরাং জোহরান মামদানির বিজয় আমেরিকার রাজনীতির প্যারাডাইম শিফট এবং বর্বর ইসরায়েলের সম্ভাব্য পতনের আলামত।
লেখক : কবি