আত্মশুদ্ধি মুমিন জীবনের প্রধান লক্ষ্য। আত্মশুদ্ধি অন্যতম ফরজ দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অন্য অনেক ফরজ বিধানের প্রতি আমরা বিশেষ যত্নবান থাকলেও আত্মশুদ্ধির বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো সচেতনতা নেই। আত্মশুদ্ধির মর্মও অনেকে জানেন না। আত্মশুদ্ধির সম্পর্ক কলব বা হৃদয়ের সঙ্গে। একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, আল্লাহ বিশুদ্ধ ও পবিত্র হৃদয় দিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠান। শিশুর হৃদয়ে কোনো অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, কামনাবাসনা কিংবা পার্থিব কোনো মোহ থাকে না। কিন্তু এই শিশুই যখন বড় হয়, ধীরে ধীরে তার অন্তর কলুষিত হতে থাকে। তার অন্তরে বাসা বাঁধে লোভ, হিংসা, অহংকারের মতো ভয়ংকর সব ব্যাধি। আপ্রাণ চেষ্টার মাধ্যমে এসব ব্যাধি দূর করতে পারার নামই আত্মশুদ্ধি।
কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করার পর ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.) আল্লাহর কাছে কয়েকটি দোয়া করেছিলেন, যেগুলো আল্লাহ আমাদের শিক্ষার জন্য কোরআনে উল্লেখ করেছেন। এর একটি দোয়া হলো : হে আমাদের রব, তাদের ভিতর থেকে তাদের মাঝে একজন রসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে এবং তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে আর তাদের পরিশুদ্ধ করবে (বাকারা)। একই ধরনের আয়াত আল্লাহ অন্যত্র উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে একজন রসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের কাছে আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন (আলে ইমরান)। লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম আয়াতে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর দোয়ার ভিতর তারা আত্মার পরিশুদ্ধিকে তৃতীয় নম্বরে রেখেছেন; কিন্তু পরের আয়াতে আল্লাহ পরিশুদ্ধিকে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছেন। এতেই বোঝা যায়, আত্মার পরিশুদ্ধি আল্লাহর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোরআনের বহু জায়গায় আল্লাহ কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে গিয়ে কসম খেয়েছেন। কোথাও একটি, দুটি বা তিনটি বস্তুর নামে শপথ করেছেন। কোথাও চারবার বা পাঁচবার শপথ করে কোনো কথা বলেছেন। কিন্তু সুরা শামছে একটি কথা বলার জন্য তিনি এগারোবার শপথ করেছেন। এগারোবার শপথ করে তিনি বলেছেন : যে পরিশুদ্ধ হলো, সে সফলকাম হলো। আর যে তা কলুষিত করল, সে ব্যর্থ হলো। সাধারণত একটি কথা বলার জন্য এতবার শপথ করা হয় না। কিন্তু আত্মশুদ্ধির কথা বলার জন্য ধারাবাহিকভাবে এগারোবার শপথ করেছেন। আত্মশুদ্ধি আল্লাহর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ- এই উদাহরণ থেকে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় হলো আত্মার শুদ্ধতা। মহান আল্লাহ বলেছেন, সেদিন সম্পদ ও সন্তান কোনো উপকারে আসবে না, ব্যতিক্রম শুধু সে, যে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে সুস্থ হৃদয় নিয়ে (সুরা শুয়ারা)। আর সুস্থ হৃদয় মানে হলো যে হৃদয় পরিশুদ্ধ, জগতের সব কলুষতা থেকে পবিত্র। রসুল (সা.) বলেছেন, জেনে রাখো, দেহে এক টুকরা মাংস আছে, তা যদি ভালো থাকে তবে সমগ্র দেহ ভালো থাকে, আর তা যদি নষ্ট হয় তবে সমগ্র দেহ নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেটি হলো হৃদয় (মুসলিম)। সাহাবিগণ রসুলের হাতে গড়া ছাত্র এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম। যাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহ আয়াত নাজিল করেছেন। তারপরও আত্মশুদ্ধির জন্য সেই সাহাবিদের যে প্রচেষ্টা, সাধনা ও আন্তরিকতা আমরা হাদিসের পাতায় পাতায় দেখতে পাই, তা প্রবাদতুল্য। হানজালা (রা.) একদিন খেয়াল করলেন, নবীজির মজলিশে থাকলে তার হৃদয় এক রকম থাকে, নবীজির মজলিশ থেকে পরিবারের কাছে গেলে হৃদয় অন্যরকম হয়ে যায়। হৃদয়ের এই পরিবর্তনকেই তিনি বলতে লাগলেন মুনাফেকি। হানজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে, ব্যাকুল হয়ে তিনি এই বাক্য আওড়াতে লাগলে নবীজি তাকে সান্ত্বনা দেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সাহাবারা নিজেদের ইমান নিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন, ইমানের সামান্য পরিবর্তনেও তারা দিশাহারা হয়ে পড়তেন।
এখন কথা হলো, আত্মাকে আমরা কীভাবে পরিশুদ্ধ রাখব? আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখতে হলে শুরুতেই আমাদের গোনাহ ত্যাগ করতে হবে। কারণ, গোনাহের ফলে অন্তর কলুষিত হয় এবং ভালোমন্দ পরখ করা কঠিন হয়ে যায়। দ্বিতীয় করণীয় হলো, কোনো পাপ হওয়ামাত্র তওবা করতে হবে। তওবার মাধ্যমে হৃদয় পরিষ্কার হয়। এরপর আল্লাহর সব আদেশ-নিষেধ মান্য করে চলতে হবে। পাশাপাশি জিকির, তেলাওয়াত, আল্লাহর জন্য রাত্রিজাগরণ, অশ্রুসিক্ত দোয়া এবং মুত্তাকি মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে হবে। এগুলো আত্মশুদ্ধির উপায় ও পথ। আমরা যদি এগুলো জীবনের সঙ্গী বানাতে পারি, আশা করা যায় পার্থিব সব কলুষতা থেকে আমাদের হৃদয় পবিত্র থাকবে। হে আল্লাহ, পরিশুদ্ধ হৃদয় নিয়ে তোমার কাছে উপস্থিত হওয়ার তৌফিক দাও।
জুমার মিম্বর থেকে
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ