১৮ কোটি মানুষের এই দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কমপক্ষে ৭৫ লাখ। বর্তমানে মাদক হিসেবে ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে ‘ইয়াবা’ নামের উত্তেজক ট্যাবলেট। দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক পাওয়া গেছে। এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, মরফিন, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন। সাম্প্রতিক সময়ে যে মাদক শিক্ষিত যুবসমাজকে গিলে ফেলেছে, তা হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। বাংলাদেশে মাদকের অবৈধ অর্থনীতির আকার এখন বেশ বড়।
সর্বনাশা মাদকের কারণে দেশের লাখ লাখ মানুষ বিপথগামী হয়ে পড়ছে। শুধু তরুণরা নয়, এখন কিশোর, এমনকি কিশোরীরাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। মাদকের বিষাক্ত ছোবলে অকালে ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। আগে মাদক বলতে ছিল প্রধানত গাঁজা। এখন সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক নাম। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর মাদক হচ্ছে ইয়াবা। ইয়াবা এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও সহজলভ্য। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সন্তানকে রক্ষার জন্য অভিভাবকদের সঙ্গে পুরো জাতি আজ শঙ্কিত। ইয়াবা হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর। এটা একধরনের মনো-উত্তেজক মাদক। ইয়াবা সেবনে কমতে থাকে জীবনীশক্তি। কিন্তু সমাজ, দেশ ও জাতিকে সুস্থ রাখতে হলে সর্বনাশা এ কারবার জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন।
কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। মাদকসেবনকারী নিজেই নিজের ঘাতক হয়ে উঠতে পারে। উঠতি বয়সি কিশোরদের অনেকে মাদকাসক্ত, যারা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, এমনকি মাদক বেচাকেনায়ও জড়িত। ফলে সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে।
মাদক এখন বাংলাদেশে সামাজিক বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও সর্বনাশা এ নেশার জগৎ ঘিরে গড়ে তুলছে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট। মাদকের প্রভাব কমানো যাচ্ছে না। ভয়ংকর সব মাদকদ্রব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও তরুণ সমাজে মাদকাসক্তি ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। মাদক সিন্ডিকেটের প্রধান লক্ষ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানরা। পাশাপাশি উঠতি বয়সি কিশোর ও তরুণরাও তাদের টার্গেট। মাদকাসক্তরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
মাদকের ভয়াবহতা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কোনোভাবেই এটা হ্রাস হচ্ছে না। বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান দেশে ঢুকছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায় দিনই একাধিক চালান উদ্ধার ও বহনকারী গ্রেপ্তার হলেও যেন অপ্রতিরোধ্য মাদক কারবারিরা। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে ইয়াবার চালান আসছে প্রতিনিয়ত। সাগর, পাহাড় আর সড়কপথে নানা কৌশলে পাচার হচ্ছে এই ভয়ংকর নেশার ট্যাবলেট।
মরণ নেশা ইয়াবা দেশের তরুণ সমাজকে এখন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করছে। মুড়িমুড়কির মতো সর্বত্র ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। ইয়াবাকে পুঁজি করে রমরমা ব্যবসা চলছে। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে সরকার। আইন প্রণয়নের চেয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ দিকটিতে জোরালো দৃষ্টি দিতে হবে।
সরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে মাদকাসক্ত মুক্ত হতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে ৮০ শতাংশ ইয়াবায় আসক্ত। দেশের বিরাটসংখ্যক তরুণশক্তি নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখছি, অথচ প্রতিনিয়ত ইয়াবার নেশায় ধ্বংস হচ্ছে তারুণ্য, জাতির ভবিষ্যৎ। তাই তারুণ্যগ্রাসী ইয়াবার বিস্তার এখন জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। ইয়াবার থাবা রুখতে হবে যে কোনো মূল্যে। সীমান্তবর্তী এলাকার মিয়ানমার অংশে ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো নিষ্ক্রিয় করা এবং এ দেশে ইয়াবা অনুপ্রবেশ রোধে সক্রিয় হতে হবে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেসব চিহ্নিত প্রভাবশালী ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ইয়াবা কারবারে জড়িত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য তাদের সহায়ক, সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। প্রশাসনিক কঠোর অবস্থান, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনসচেতনতাই পারবে ইয়াবার শিকড় উপড়ে ফেলে এর বিস্তার ঠেকাতে।
মাদকের কারবার বন্ধ করা না গেলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ধরনের স্থিতিই বিঘ্নিত হবে। তাই মাদকের বিস্তার রোধে কারবারিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারকে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও তৎপর হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। নেশামুক্ত তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলতে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ইউটিউবে মাদকবিরোধী অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। সন্তানের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। গতানুগতিক একঘেয়ে জীবন থেকে তারুণ্য শক্তিকে সৃষ্টির নেশায় গড়ে তুলতে হবে। না হলে এই দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য