আজ ৫ আগস্ট। ফ্যাসিবাদী মুক্তির প্রথম বর্ষপূর্তি। গত বছরের এই দিনে হাজারো ছাত্র-তরুণের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছিল। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের। বৈষম্যমুক্তির স্বপ্নে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু গত এক বছরে সেই স্বপ্ন বিবর্ণ। আশাহত আর হতাশার বেদনায় আক্রান্ত মানুষ আজ। জাতি এই সংকটকালে আপনার দিকে তাকিয়ে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। জাতি আজ আপনার এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আপনার একটি ঘোষণা গোটা জাতিকে দিতে পারে স্বস্তি। নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব। আপনি শান্তিতে নোবেলজয়ী। আপনার সাফল্য অপরিসীম। আপনার জীবনে কোনো ব্যর্থতার গ্লানি নেই। আপনি ব্যক্তিগত লোভের ঊর্ধ্বে মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এক জীবন্ত কিংবদন্তি। আর সে কারণেই গত বছর আপনাকে সবাই ঐক্যবদ্ধ দলমত নির্বিশেষে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। দুঃসময়ে আপনি কাণ্ডারি হিসেবে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। আজ বাংলাদেশ স্বৈরাচার মুক্তির এক বছর পূর্ণ করেছে আপনার নেতৃত্বে। এ সময় ভালোমন্দ মিলিয়ে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা, কিন্তু একটি বিষয়ে জনগণ নিশ্চিত, আপনার আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। আপনি দেশটাকে বদলে দিতে চান। দেশে একটি সুন্দর সুশাসনের বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনার আগ্রহ এবং চেষ্টার কোনো কমতি নেই। এ সময় আপনি নিরন্তর পরিশ্রম করে গেছেন বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের হাত থেকে তুলে একটি সঠিক পথে নিয়ে যেতে। কিন্তু গত এক বছর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাধি দেখা দিয়েছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব। চাঁদাবাজির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে সর্বত্র। চাঁদাবাজি কোথায় নেই? একজন মানুষের শেষ ঠিকানা কবর থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নদীর ঘাট, বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে সড়ক, মহাসড়ক। সরকারি অফিস-আদালত কোথায় নেই চাঁদাবাজি? ছোট ছোট মুদির দোকান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প স্থাপনা, বাণিজ্য কেন্দ্র-সর্বত্র আজ চাঁদাবাজির আতঙ্ক। সর্বত্র চাঁদাবাজির এক ভয়ংকর বিস্তৃতি জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে মানুষ যেন অসহায়। কেউ শান্তিতে নেই। এখন মানুষ আতঙ্কে জীবনযাপন করছে। আপনি ঘরে শান্তিতে থাকতে পারবেন না, চাঁদাবাজদের দ্বারা আক্রান্ত হবেন। এ শঙ্কায় আপনার কাটবে বিনিদ্র রজনি। আপনি কর্মক্ষেত্রে নিরাপদে থাকতে পারবেন না, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য আপনার কর্মজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। আপনি ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও নিরাপদে যেতে পারবেন না। পরিবহন চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য আপনার যাত্রাপথকে করে তুলবে দুর্বিষহ। চাঁদাবাজি এখন এক মহামারির মতো বিস্তৃত হয়েছে। চাঁদাবাজি যেন এখন করোনাভাইরাসের চেয়েও ব্যাপক বিস্তৃত।
বাংলাদেশে গত এক বছরে সবচেয়ে বড় ব্যাধির নাম চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজির কারণেই মব সন্ত্রাস হচ্ছে, দখলদারিত্ব হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তিরা সংঘবদ্ধ হয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল করে নিচ্ছে। জোর করে ফসলের জমির মাটি কেটে দেওয়া হচ্ছে ইটের ভাটায়। এটিও চাঁদাবাজির আরেকটি ভয়ংকর রূপ। এরকম অবস্থা যদি বাংলাদেশে চলতে থাকে, তাহলে একসময় বাংলাদেশে কৃষিজমি থাকবে না। দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যাবে। এভাবে যদি চাঁদাবাজি চলতে থাকে, তাহলে মানুষ ঘর থেকে বের হবে না। বাংলাদেশে সব কর্মচাঞ্চল্য বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে যদি চাঁদাবাজি চলতে থাকে, তাহলে এ দেশের কোনো মানুষ নিরাপদে থাকবে না। চাঁদাবাজির এই ভয়ংকর ব্যাধিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। কেউ শান্তিতে নেই। একেবারে নিরন্ন রিকশাচালক থেকে শুরু করে একজন শিল্পপতি প্রত্যেকেই এখন চাঁদাবাজিতে আক্রান্ত, ক্ষতবিক্ষত, বিপর্যস্ত। আর এখান থেকে উদ্ধারের একটাই পথ, তা হলো চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আজ বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য দিন। বাংলাদেশ আজ জুলাই বিপ্লবের প্রথম বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে। আমরা ফ্যাসিস্টকে বিদায় দিয়েছি। বাঙালিদের কাছে অসাধ্য কিছু নেই। আমরা যদি ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটাতে পারি, তাহলে কেন চাঁদাবাজমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে পারব না? এ কাজটি আপনিই পারেন। কারণ আপনি জাতির অভিভাবক। আপনি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক। আপনার একটি নির্দেশনার ফলে পুরো দেশের ভাগ্য বদলে যেতে পারে। আজকের দিনে অন্তত একটি আদেশ আপনি দিন, চাঁদাবাজমুক্ত বাংলাদেশ হবে, কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেওয়া হবে না। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হবে পক্ষপাতহীনভাবে। চাঁদাবাজের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হবে না। তার একটাই পরিচয়, সে দেশের শত্রু। জনগণের শান্তি বিনষ্টকারী, দেশের উন্নয়নবিরোধী।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনার কথা সবাই মানে। গোটা জাতি আপনাকে শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে। আপনার ওপর মানুষ আস্থা রাখে। আর এ কাজটি যদি আপনি করতে পারেন, এ একটি সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশ বদলে যাবে। আমরা জানি যে, যারা চাঁদাবাজ তারা সুবিধাভোগী মতলববাজ, দুষ্টু প্রকৃতির লোক। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হতে পারে না। কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের গ্রহণ করে, সেটি ওই রাজনৈতিক দলের ভুল এবং ব্যর্থতা। সব রাজনৈতিক দলকে আপনি অঙ্গীকার করতে বলুন। তারা যেন এই অঙ্গীকার করে যে, তারা কোনো চাঁদাবাজ, দখলদার এবং সন্ত্রাসীদের দলে জায়গা দেবে না। চাঁদাবাজদের সামাজিকভাবে, জাতীয়ভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে বয়কট করা হবে। এটি আপনার পক্ষেই সম্ভব। আজকের এই দিনে আপনি জুলাই ঘোষণাপত্র দেবেন। আজকে আপনি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। নির্বাচন, গণতন্ত্র মানুষের আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে যদি বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্য কর্মচাঞ্চল্য বন্ধ হয়ে যায়। চাঁদাবাজির কারণে আজ দেশের অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ।
চাঁদাবাজি আজ যে ভয়ংকর দানবে পরিণত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকলাঙ্গ হওয়ার অবস্থা। আপনি নিশ্চয়ই সব জানেন, বোঝেন। চারপাশের সব খবর আপনার কাছে আছে। যারা অতীতে দুর্বৃত্ত ছিল, যারা অতীতে সন্ত্রাসী ছিল, যারা অতীতে চাঁদাবাজ ছিল তারা এখন রং বদলেছে। নতুন মোড়কে তারা আরও ভয়ংকরভাবে চাঁদাবাজি করছে। আর অসহায় হলো সাধারণ মানুষ। ব্যবসায়ীরা আজ বিপর্যস্ত। তারা চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ। কেউ মুখ খুলতে পারছেন না। এখন আপনার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি বিশ্বশান্তির পথপ্রদর্শক। আপনি বিশ্বে তারুণ্যের জাগরণের বিপ্লবী বীর। আপনি পারেন চাঁদাবাজমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ দেখাতে। আপনার একটা ছোট্ট সিদ্ধান্ত এবং একটা ছোট্ট নির্দেশনা এ জাতিকে মুক্ত করতে পারে চাঁদাবাজদের হাত থেকে। আপনি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক। আজ থেকে দেশের নির্বাচনের আমেজ শুরু হবে। রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের পক্ষে-বিপক্ষে যাবে। রাজনৈতিক মত-পথের নানারকম বিভক্তি আমরা দেখব। চাঁদাবাজরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। কিন্তু আপনি যদি একটি শপথ আজকের দিনে সব রাজনৈতিক দলকে করান, তারা চাঁদাবাজদের প্রত্যাখ্যান করবে, তাহলে এ দেশের জন্য আজকের দিনটি হবে ঐতিহাসিক। আজকে আপনি যে মহাসম্মিলন করবেন সেখানে সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা থাকবেন, থাকবেন জুলাই বিপ্লবের বীরযোদ্ধারা। তাদের সামনে যদি আপনি এই একটি শপথ করান, তাহলে দেশ বহুদূর এগিয়ে যাবে। এ দেশের জনগণ শঙ্কামুক্ত হবে। এ দেশের অর্থনীতি রাহুমুক্ত হবে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আপনার কঠোরতম অবস্থান এবং ঘোষণা। আপনাকে দেবে অমরত্ব।
শুধু ঘোষণা নয়, আপনি চাঁদাবাজের ব্যাপারে কঠোর আইন করুন। বাংলাদেশে অনেক কঠোর আইন করা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য কঠোর আইন করা হয়েছে। কিন্তু চাঁদাবাজদের ব্যাপারেও সেরকম একটি কঠোর আইন আপনি তৈরি করেন একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে। আপনি যেহেতু জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক, সবাই আপনাকে মানে, সম্মান করে সেজন্য আপনি যখন এ অধ্যাদেশটি করবেন, তখন সবাই মান্য করবে। তবে শুধু অধ্যাদেশ জারি করে নয়, এ অধ্যাদেশ বা আইন যেন অক্ষরে অক্ষরে সবাই মানে, সেটি আপনি বাস্তবায়ন করবেন। এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। এ দেশের মানুষ আপনাকে সারাজীবন স্মরণ করবে। কারণ আমরা যদি বাংলাদেশের সমস্যার গভীরে যাই, আমরা যদি দেখি কেন গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়েছি? কেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকে চেপে বসেছিল? কেন আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে? কেন আমরা বারবার প্রতারিত হয়েছি? তার উত্তর হবে একটাই, তা হলো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস এবং দুর্বৃত্তদের কারণে। এসব চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্ত সব সময় ক্ষমতা কেন্দ্রের চারপাশে এসে ভিড় করেছে। তারা ক্ষমতা কেন্দ্রের প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি করেছে, চাঁদাবাজি করেছে, বিদেশে অর্থ পাচার করেছে। এদের প্রতিহত করার দিন আজ। আমরা গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। আসুন আজ আমরা নতুন বাংলাদেশের শপথ নিই। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের শপথ হোক চাঁদাবাজভুক্ত, দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ। সেজন্য আপনাকে কঠোর হতে হবে। আমরা দেখেছি যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপনার কঠোর অবস্থান। আপনি সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ঐক্যের ডাক দিন। আপনার নেতৃত্বে আমরা আজকের দিনে শপথ নিই, চাঁদা যে চাইবেন, তিনি অপরাধী এবং কেউ চাঁদা দেবে না। চাঁদাবাজদের ব্যাপারে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করবে। এটি যদি আমরা করতে পারি তাহলেই স্বৈরাচার মুক্তির স্বপ্ন পূরণ হবে। না হলে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে আমাদের সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা বিলীন হয়ে যাবে।