গাজার আকাশ আগের মতো নীল আর শান্ত নেই। কেবল যুদ্ধবিমান আর ধোঁয়ার কুণ্ডুলী দেখা যায়। প্রতিদিন নতুন কোনো ভবন ধসে পড়ে, নতুন কোনো কান্নার আওয়াজ ওঠে। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপের মাঝেও কিছু স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে। ছোট্ট সারা সেই স্বপ্নেরই এক অংশ। সারার বয়স মাত্র দশ, কিন্তু সে জানে যুদ্ধ তার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। বাবা নেই, মা অসুস্থ, আর যে স্কুলটায় সে পড়ত, সেটাও এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। কিন্তু সারার মন মানে না। সে পড়তে চায়, লিখতে চায়, শিখতে চায়। আর সে চায়, তার আশপাশের অন্য বাচ্চারাও পড়াশোনা করুক। তাই এক দিন সে ঠিক করল-গোপনে একটা স্কুল চালু করবে! তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশেই একটা ছোট্ট পরিত্যক্ত গ্যারেজ ছিল। সে আর তার বন্ধু রাইদ সেটাকে একটু পরিষ্কার করল। মাটিতে পুরোনো কার্পেট বিছিয়ে দিল, আর একটা ভাঙা টেবিলকে ব্ল্যাকবোর্ড বানাল। কাচের টুকরো থেকে সাবধানে কিছু চক বানিয়ে নিল তারা।
পরদিন সকালে সারা তার আশপাশের শরণার্থী শিশুদের ডেকে আনল। বয়স পাঁচ থেকে বারো-এমন দশ-বারোটা শিশু সেখানে জড়ো হলো। তারা বই আনতে পারেনি, কলমও নেই, কিন্তু শিখতে চায়!
সারা বোর্ডে প্রথম লিখল- ‘আলোর পথে যাত্রা’।
তারপর সে শেখাতে লাগল-অঙ্ক, আরবি হরফ, ছোট ছোট ইংরেজি শব্দ। রাইদ ইতিহাসের গল্প শোনাল, আর ছোট্ট ফাতিমা গান গেয়ে শোনাল, যা তাদের দাদি এক সময় শিখিয়েছিল।
এভাবেই চলতে থাকল গোপন স্কুল। তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে বই খুঁজত, কাগজ কুড়িয়ে আনত, কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে কাঠকয়লা দিয়ে লিখত। এক দিন, যুদ্ধবিমান আবার হামলা চালাল। আশপাশের কিছু তাঁবু ধ্বংস হয়ে গেল, গ্যারেজের একপাশও ভেঙে পড়ল। শিশুরা ভয়ে কাঁদছিল, কিন্তু সারা শক্ত ছিল।
সে বলল, ‘আমরা থামব না। যতক্ষণ আমরা শিখছি, ততক্ষণ আমাদের হারাতে পারবে না!’
সেই রাতে সারার মা দেখলেন, তার ছোট্ট মেয়ে কাগজে কিছু লিখছে। কাছে গিয়ে দেখলেন, সারা লিখেছে-‘যুদ্ধ আমাদের বই ছিনিয়ে নিতে পারে, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন কেড়ে নিতে পারবে না!’
গাজার আকাশে তখনো ধোঁয়া ছিল, কিন্তু ধ্বংসস্তূপের নিচে একটা স্বপ্ন জ্বলছিল-সারার গোপন স্কুল, যেখানে আশার আলো নিভে যেতে পারে না।
সারার লেখা কথাগুলো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নতুন শক্তি জাগিয়ে তুলল। পরদিন সকালেই সে আবার গ্যারেজের ভাঙা অংশ ঠিক করার চেষ্টা করল। আশপাশের কিছু বয়স্ক মানুষও এসে সাহায্য করল। তারা জানত, এই শিশুদের শেখার ইচ্ছা যুদ্ধের থেকেও বড়। কিন্তু বিপদ তখনো শেষ হয়নি।
সন্ধ্যার দিকে একজন অপরিচিত লোক শরণার্থী শিবিরে এসে সারার খোঁজ করল। তার চোখ ছিল কুটিল, গলায় রেডিওর তার ঝুলছিল। তিনি কিছু মানুষের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বললেন। তারপর ধীরে ধীরে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে গেলেন। সারা দূর থেকেই লোকটাকে দেখে ফেলেছিল। তার বুক ধকধক করছিল। রাইদ ফিসফিস করে বলল, ‘সারা, আমরা ধরা পড়ে যাচ্ছি না তো?’
সে ইশারা করল, ‘শোনো, সবাই জিনিসপত্র লুকিয়ে ফেলো। ব্ল্যাকবোর্ড মাটিতে শুইয়ে দাও, বইগুলো ইটের নিচে রাখো। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, বলবে এখানে শুধু খেলাধুলা করি।’ লোকটি এসে দাঁড়াল। তার চোখ সরাসরি সারার চোখে আটকে গেল।
‘তুমি কি এখানে কিছু শেখাচ্ছ?’
সারা ভয় লুকিয়ে বলল, ‘না চাচা, আমরা শুধু খেলি।’
লোকটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, তারপর হেসে বলল, ‘ভালো! তবে মনে রেখো, এখনকার দিনে শেখার চেয়ে বেঁচে থাকাটা বেশি জরুরি।’
সে ধীরে ধীরে চলে গেল। সারা আর রাইদ তখনো নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল।
রাতের বেলা, সারার মা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুমি জানো তো, তুমি কতটা বড় কাজ করছ?’
সারা মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা, কিন্তু ভয় হয়’
তার মা বললেন, ‘আলো কখনো অন্ধকারকে ভয় পায় না।’ এরপর দিনগুলোর মধ্যে যুদ্ধ আরও বেড়ে গেল। কয়েকটা ঘর ধ্বংস হয়ে গেল, কিছু পরিবার শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো। কিন্তু সারার স্কুল বন্ধ হলো না। যতই ভয় আসুক, যতই ধ্বংস আসুক, সারা জানে আশার আলো কখনো নিভে যায় না।
যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকল। প্রতিদিন নতুন নতুন হামলা হচ্ছিল, খাবার কমে আসছিল, পানি পাওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সারার স্কুল চলছিল আগের মতোই। শিশুরা কষ্টের মধ্যেও একটু সময়ের জন্য ভুলে যেত তারা কোথায় আছে। কিন্তু একদিন ভয়ংকর কিছু ঘটল। সকালে, যখন সারা স্কুলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, হঠাৎ বিকট শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। সবাই দৌড়ে বাইরে এলো। ধুলো আর ধোঁয়ার মধ্যে দেখা গেল সারার নিজের স্কুলটাও আর নেই!
ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে সারা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পানি আসেনি, কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করছিল। রাইদ, ফাতিমা, আর অন্য শিশুরাও নীরব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাইদ বলল, ‘এখন আমরা কী করব?’ সারা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। তারপর বলল, ‘আমরা আবার শুরু করব।’
সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। সে একটা ইট হাতে নিয়ে বলল, ‘যতবার আমাদের স্বপ্ন ভাঙবে, আমরা আবার গড়ে তুলব। কারণ আমাদের স্বপ্ন ধ্বংস করা যায় না!’ পরদিন সবাই মিলে একটা নতুন জায়গা খুঁজল। এবার তারা স্কুল চালাবে ধ্বংসস্তূপের নিচের এক পুরোনো বেজমেন্টে। এখানে বাইরের কেউ সহজে জানতে পারবে না। এক সন্ধ্যায় এক বৃদ্ধ লোক শরণার্থী শিবিরে এলেন। তার হাতে ছিল কিছু বই আর খাতা। তিনি সারার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি সেই ছোট্ট শিক্ষিকা, তাই তো?’ সারা মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি শুধু চেষ্টা করি।’ লোকটি হাসলেন, তারপর তার হাতে একটা খাতা দিলেন। ‘এই খাতায় লিখে রেখো, তুমি কী কী শিখিয়েছ। একদিন যখন গাজা মুক্ত হবে, এই খাতা দিয়ে তোমরা আবার সত্যিকারের স্কুল গড়তে পারবে!’ সারা খাতাটা শক্ত করে ধরে রাখল। তারপর থেকে স্কুলটি আগের মতোই চলতে লাগল। আর সেই খাতার প্রতিটি পাতায় লেখা হতে থাকল স্বপ্নের গল্প। এক দিন যুদ্ধ শেষ হবে, গাজা আবার জেগে উঠবে। আর তখন সবাই বলবে-‘একটি ছোট্ট মেয়ে, যে কখনো হার মানেনি, সেই ছিল নতুন দিনের আলো!’