শনিবার, ৩০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

ফারুক যেভাবে চলচ্চিত্রে

দেশীয় চলচ্চিত্রে মিয়াভাই খ্যাতি পাওয়া জনপ্রিয় একজন অভিনেতার নাম ফারুক। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। বলিষ্ঠ অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন তিনি। তার চলচ্চিত্র জীবনের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

ফারুক যেভাবে চলচ্চিত্রে

অভিনেতা হিসেবে যাত্রা

‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবির এ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। আর এ গানটি শুনলেই একজন দক্ষ অভিনেতার ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তিনি হলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুক। যার পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ফারুক নামটি তাকে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকী নাম হিসেবে। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং ফারুক নামে নিজের একজন বন্ধু মিলে তাকে দিয়েছিলেন এ নাম। ছাত্রজীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্রে আসার কারণ হিসেবে এই কিংবদন্তি অভিনেতা বলেন, ছাত্রলীগ করার

কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমার বিরুদ্ধে ৩৭টি হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে। এসব মামলা থেকে বাঁচতে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে চলচ্চিত্রে আসি।

 

বেড়ে ওঠা

বাবা ছিলেন চিকিৎসক। জন্ম পুরান ঢাকায় ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। বাবার নাম আলহাজ ডা. আজগার হোসেন পাঠান। ফারুক ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অংশগ্রহণে কোনো রক্তচক্ষু তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলায়। নিজের আদর্শ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

চলচ্চিত্রে নিয়মিত

মুক্তিযুদ্ধের পরেও বন্ধুবান্ধবরা তাকে জোর করে নিয়ে আসেন চলচ্চিত্রে। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। এ ছবিতে ফারুকের চরিত্র ছিল বেশ গভীর। এতে তাকে জাতীয় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে চূড়ান্ত করা হলেও তৎকালীন বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সরকার জোর করে তাকে পার্শ্বঅভিনেতার পুরস্কার দেয়। এই দুঃখের  বোঝা এখনো বইছেন বলে জানিয়ে এই আপসহীন অভিনেতা দুঃখ করে আরও জানান, আমাকে ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১৯ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারে চূড়ান্ত করা হলেও শুধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হওয়ায় ১৯ বারই এই পুরস্কার থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া আরেকটি ছবি তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছবিটি হলো ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্প। মেলোড্রামাটিক ছবি। এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন ফারুক। এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদেই আমাদের চলচ্চিত্রে গ্রামীণ যুবকের চরিত্রে ফারুক স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিটির বাণিজ্যিক সাফল্য ফারুককে নায়ক হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ মুক্তি পায়। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত এ  ছবিটির ‘কদম সারেং’ চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন। সে বছরই আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে মিলন চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন ফারুক। বিশেষ করে মৃত্যুর দৃশ্যে তার অভিনয় দর্শককে কাঁদায়। ১৯৭৯ সালে ফারুক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান নায়ক। সে বছর তার অভিনীত ৩০টির বেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বিশেষ করে গ্রামীণ তরুণের আইকন হয়ে যান তিনি। আজিজুর রহমান নির্মিত ‘জনতা এক্সপ্রেস’ ছবিতে নিজের শিশু সন্তানকে বলি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন এমন এক ট্রেনচালকের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন ফারুক। ‘মিয়াভাই’ ছবিটি সাফল্য পাওয়ার পর দর্শকমহলে তার ‘মিয়াভাই’ নামটি জনপ্রিয়তা পায়। নব্বই দশকের শেষে কয়েকটি চলচ্চিত্রে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দেখা যায় ফারুককে। তবে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য তিনি রুপালি পর্দা থেকে কিছুটা দূরে সরে যান। কিংবদন্তি এই অভিনেতা বলেন, বেশ কয়েকটি ছবির শেষ দৃশ্যে তার চরিত্রের মৃত্যুর কারণে অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধা তাকে ট্রাজিডি কিং হিসেবেও আখ্যা দেন। যেমন-গোলাপী এখন ট্রেনে, দোস্তী,  প্রতিজ্ঞা, লাল কাজল, নাগরদোলা প্রভৃতি।

এখনো সক্রিয়

বেশ ক’বছর অভিনয় না করলেও তিনি সব সময় আছেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন নিয়ে ঘটিত চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক তিনি। চলচ্চিত্রে এক সময় যখন ধস নামে তখন সবার আহ্বানে চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে তিনি পরিবেশক সমিতির নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং চলচ্চিত্রের অন্য সংগঠনগুলোকে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নানা পদক্ষেপ নিয়ে এই ধস দূর করেন। তখন দেশে থাকা ৭শত সিনেমা হলকে প্রায় ১৪শতে উন্নীত করেন। এরপর সফলভাবে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স প্রবর্তনে ভূমিকা রাখেন। ফারুক হলেন চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এ সমিতি প্রতিষ্ঠা করলেও নিজে এর সভাপতি না হয়ে নায়করাজ রাজ্জাককে তিনি সভাপতি হতে প্রস্তাব রাখেন। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমানভাবে সক্রিয় তিনি। ১১তম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ১৭ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এমনকি এই করোনাকালেও ঘরে বসে না থেকে প্রতিদিন সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে ছুটে চলেছেন অসহায় মানুষের দ্বারে দ্বারে। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি তিনি। বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন এর সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি এবং জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে মিছিল নিয়ে নেমে আসেন। রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পর আবার কি অভিনয়ে ফিরবেন অভিনেতা ফারুক? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ক্যামেরায় সামনে আসাই যায়। না আসার কোনো কারণ নেই। অভিনয় করতে পারি! তবে আমার কিছু শর্ত আছে। ভালো গল্প ও চরিত্র লাগবে। সুন্দর কিছু দেখলেই নকলের প্রবণতা দেখা যায়। কাজ করলে মৌলিক জিনিসে কাজ করব। যাদের সঙ্গে কাজ করব তাদের সিনসিয়ারিটি থাকতে হবে। বছর তিনেক আগে তিনটি সিনেমা নির্মাণের কথা বলেছিলেন ফারুক। ওই ছবিগুলো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ফারুক বলেন, আগেই বলেছি ছবি বানালে চালাব কোথায়? সব কিছু ঠিক হলে তারপর ছবি বানাবো। যে ইমেজটা আল্লাহপাক দিয়েছেন, আমি সেখানেই থাকতে চাই। এককথায় অভিনয়ের ভবিষ্যৎ যেটা ছবি বানানোর ভবিষ্যৎ সেটা। বরং অভিনয়ের চেয়ে ছবি বানানোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বেশি পরিবেশ ঠিক হওয়ার ওপর। শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মিয়াভাই খ্যাত অভিনেতা ফারুক। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও বাচসাস-সহ অগণিত গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননায় ভূষিত হন মিয়াভাই ফারুক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর