বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে আসতে চাননি চম্পা

ঢাকাই চলচ্চিত্রের তিনকন্যা খ্যাত সুচন্দা ববিতা ও চম্পা। এই তিন বোনের ছোটজন হলেন গুলশান আরা চম্পা। চলচ্চিত্রে অভিনয়ে তার ইচ্ছে না থাকলেও এ অঙ্গনে সফল হন তিনি। তাকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

চলচ্চিত্রে আসতে চাননি চম্পা

চলচ্চিত্রের প্রতি অনাগ্রহ

চলচ্চিত্রে অভিষেকের আগে আশির দশকে সাপ্তাহিক বিচিত্রা ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে চম্পা বলেছিলেন, তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন না। ওই সময় কোনো একজন বলেছিলেন, দুই বোনের মতো চলচ্চিত্রে চম্পা সফল হবে না। এ কথা শুনে জেদের বসে তার চলচ্চিত্রে আসা। তিনি তার দুই বোনকে দেখে কখনো ভাবেননি যে তিনি চলচ্চিত্রে আসবেন। চলচ্চিত্রে তাদের ব্যস্ততার লাইফ চম্পার পছন্দ ছিল না।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে...

বড় বোন সুচন্দার আগ্রহে চলচ্চিত্রে চম্পার অভিষেক ১৯৮৬ সালে, শিবলী সাদিকের ‘তিন কন্যা’ ছবির মাধ্যমে। এ ছবির প্রযোজক ছিলেন সুচন্দা। তারা তিন বোনই (সুচন্দা ববিতা চম্পা) এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এ ছবিতে একজন পুলিশ ইনসপেক্টরের ভূমিকায় চম্পার অভিনয় অনেকেরই নজর কাড়ে। এতে একের পর এক বাণিজ্যিক ছবিতে চম্পা অভিনয় করেন এবং ছবিগুলোও ব্যবসা সফল হতে থাকে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নব্বই দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের এক নম্বর নায়িকা ছিলেন চম্পা। সামাজিক, সামাজিক অ্যাকশন, ফোক-সব ধরনের ছবিতে তিনি সফলতা পান। তখন স্লোগান ছিল ‘চম্পা মানেই ভালো ছবি’। তিন কন্যার পরপরই প্রচন্ড সাফল্য আসে ‘সহযাত্রী’ এবং ‘ভেজা চোখ’ ছবিতে। এর পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকতে হয়নি। পর পর বহু ছবি হিট হওয়ায় তিনি দেশের একজন আলোচিত শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। চম্পা প্রথম থেকেই বৈচিত্রাবিলাসী। চরিত্রের প্রয়োজনে কোনো রূপসজ্জা ছাড়াই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হন না তিনি।

 

ওপার বাংলায়ও প্রশংসিত

কলকাতার চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান নির্মাতা গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ‘মনের মানুষ’ ছবিতে অভিনয় চম্পাকে একটি আলাদা স্থানে নিয়ে যায়। তার খ্যাতির সীমানা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পদ্মা নদীর মাঝি ছবিতে মালা চরিত্রে অসামান্য অভিনয়ের সূত্রে চম্পা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পেও। সত্যজিৎ তনয় সন্দীপ রায় ‘টার্গেট’ ছবিতে চম্পাকে নির্বাচন করেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তও ‘লাল দরজা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান। ছবির পরিচালক বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত এবং প্রযোজক হচ্ছেন বাপ্পি লাহড়ী। বুদ্ধদেব দিল্লি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘টার্গেট’ ছবিটি দেখার পর তাকে ‘লাল দরজা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পছন্দ করেন। মূলত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ তার ভিত্তি ভূমি। কেননা, ওখান থেকে ‘টার্গেট’, তারপর ‘লাল দরজা’ এবং তারপর গৌতম ঘোষের ‘আবার আরণ্যে’ ছবিতে তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান।

 

ছোট পর্দাতেই অভিনয় শুরু

১৯৮১ সালে বিটিভিতে আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও প্রযোজিত ‘ডুব সাঁতার’ নামে একটি নাটকের মধ্য দিয়ে তার অভিনয় জীবনের শুরু। এছাড়া তিনি অভিনয় করেন ‘শাহাজাদির কালো নেকাব’, ‘আকাশ বাড়িয়ে দাও’, ‘খোলা দরজা’, ‘একটি যুদ্ধ অন্য একটি মেয়ে’, ‘অপয়া’, ‘এখানে নোঙর’ ইত্যাদি নাটকে। এসব নাটকে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বর্তমান সময় পর্যন্ত চম্পা যতগুলো নাটকে অভিনয় করেছেন তার মধ্যে চম্পার সবচেয়ে প্রিয় নাটক হচ্ছে ‘এখানে নোঙর’। এখনো তিনি সমান জনপ্রিয়তায় ছোট পর্দার নাটকে অভিনয় করে যাচ্ছেন।

 

ফ্যাশনের প্রতি দুর্বলতা

ফ্যাশনের প্রতিই সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা চম্পার। সত্তর বা আশির দশকে বর্তমান সময়ের মতো এত ফ্যাশন ডিজাইনার ছিল না, আবার ভিসিআর ভিসিপিও ছিল না যা দেখে তিনি শিখতে পারেন। টেলিভিশনে দু-একটা ইংরেজি ছবি দেখার পর তার ভিতরে ফ্যাশনের প্রতি দুর্বলতা জন্মায়। এক্ষেত্রে ম্যাগাজিনগুলোও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পুরো বিষয়টি আসলে তার নিজের মন থেকেই এসেছে। নতুন সব ফ্যাশন নিয়ে সব সময় তিনি ভাবতেন। এক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছেন। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও চম্পা মডেল হয়েছেন। কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র সুপারহিটও হয়েছে।

অভিনয়ের স্বীকৃতি

চম্পা-সেরা অভিনেত্রী হিসেবে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। এগুলো হলো- গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, শাহজাহান চৌধুরীর ‘উত্তরের খেপ’ ও শেখ নেয়ামত আলীর ‘অন্যজীবন’। আর সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে দুবার চাষী নজরুলের ‘শাস্তি’ এবং মুরাদ পারভেজের ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও ‘জিয়া স্বর্ণপদক’ ও ‘শেরেবাংলা পদক’ পেয়েছেন। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে অভিনয়ের দক্ষতার জন্য ভারত থেকে পদক পেয়েছেন। কলকাতার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু তাকে পুরস্কৃত করেন। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তাসখন্দ ফ্লিম ফেস্টিভ্যাল থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তার অভিনীত ‘লাল দরজা’ ছবিটি অস্কারের নমিনেশন পেয়েছিল।

 

উল্লেখযোগ্য ছবি

চম্পা অভিনীত উল্লেখযোগ্য এবং ব্যবসাসফল ছবির তালিকা বিশাল। তার মধ্যে ‘তিনকন্যা’, ‘সহযাত্রী’, ‘ভেজা চোখ’, ‘নিষ্পাপ’, ‘দুর্নাম’, ‘বিরহ ব্যথা’, ‘অবুঝ হৃদয়’, ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’, ‘মাটির কসম’, ‘বন্ধন’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’, ‘পালাবি কোথায়’, শঙ্খনীল কারাগার’, ‘জন্মদাতা’, ‘নীতিবান’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘একখন্ড জমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

পারিবারিক পরিচিতি

গুলশান আরা চম্পা। পঞ্চাশ দশকে যশোর শহরে সার্কিট হাউসের সামনে পৈতৃক বাড়ি রাবেয়া মঞ্জিলে চম্পার জন্ম। জন্মতারিখ ৫ জানুয়ারি। বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব (আবু) একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। ১৯৮২ সালে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম খানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ব্যক্তিগত জীবনে চম্পা ব্যবসায়ী স্বামী ও কন্যা এষাকে নিয়ে রুচিশীল সুখী জীবনযাপন করছেন।

 

চম্পার ইচ্ছা...

চম্পা মনে করেন তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন সুন্দরী হয়ে থাকবেন। তিনি নিজেকে সব সময় ইয়াং রাখতে চান। আর এ জন্য তিনি নিয়মিত ব্যায়াম ও রূপচর্চা করেন। চম্পা মনে করেন নিজেকে ইয়াং হিসেবে ধরে রাখাটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। শুধু ব্যায়াম ও রূপচর্চা করেই এ কাজে সফল হওয়া সম্ভব নয়, এগুলোর পাশাপাশি মনটাকে সবুজ রাখা প্রয়োজন। মনকে ইয়াং ও সবুজ রাখলে বয়স বাড়লেও বয়সের ছাপ সহজে চেহারার ওপর পড়ে না। মনকে ইয়াং রাখতে তিনি প্রচুর গান শোনেন। ফুল, পাখি ও গাছপালা ভালোবাসেন, ছোট বাচ্চাদেরও ভালোবাসেন। রাস্তার টোকাই ও বয়স্ক লোকদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা আছে গুলশান আরা চম্পার।

সর্বশেষ খবর