শুক্রবার, ১২ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বর্ণালি সংগীতের সম্রাজ্ঞী সাবিনা ইয়াসমিন

স্বর্ণালি সংগীতের সম্রাজ্ঞী সাবিনা ইয়াসমিন

সাবিনা ইয়াসমিন। দেশাত্মবোধক গান থেকে শুরু করে প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলা গানের বিভিন্ন ধারায় তার সরব বিচরণ। উচ্চাঙ্গ, ধ্রুপদ এবং লোকসংগীত থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা গানসহ চলচ্চিত্রে মিশ্র আঙ্গিকের গানে মায়াবী কণ্ঠ কাজের জন্য এ সংগীতশিল্পীর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। উপমহাদেশের এক জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। পাঁচ দশকে প্রায় ১৬ সহস্রাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পেয়েছেন ১৪টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ নানান সম্মাননা। স্বর্ণালি সংগীতের এ সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে লিখেছেন-

আলী আফতাব

 

সপ্তসুরে তার জীবন বাঁধা। সারা জীবন একটি কাজই করেছেন গান, গান আর গান। বাধা যে আসেনি তা নয়। কিন্তু গান তিনি ছাড়েননি কিংবা গান তাকে ছেড়ে যায়নি। এমনকি রোগব্যাধিতেও নয়। সাবিনা গানের হাতেখড়ির কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন যখন দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে তালিম নিতেন তখন ওর পাশে আমিও থাকতাম। ওখান থেকেই গানের প্রতি ভালোবাসা’। পরে ওস্তাদ পিসি গোমেজের কাছে টানা ১৩ বছর তালিম নিয়েছেন। আর এভাবেই গানের জগতে প্রবেশ। ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরায় জন্ম নেওয়া সাবিনা ইয়াসমিনের ৫ বোনের মধ্যে ৪ বোনই গানের ভুবনের মানুষ- ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমিন ও সাবিনা ইয়াসমিন। মাত্র ৭ বছর বয়সে স্টেজ প্রোগ্রামে অংশ নেন সাবিনা। ছোটদের সংগঠন খেলাঘরের সদস্য হিসেবে রেডিও ও টেলিভিশনে গান করেছেন নিয়মিত। ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ এবং ‘মধুর জোছনা দীপালি’ গানটির মাধ্যমে তিনি প্লেব্যাক গায়িকার খাতায় নাম লেখান। তবে, ‘তারও আগে নতুন সুর ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে গান করেছিলাম’ জানালেন সাবিনা।

ছোটবেলায় প্রতিমা ব্যানার্জির মতো গান গাইতে চেষ্টা করতেন তিনি। লতা, আশা, নির্মলা মিশ্র, গীতা দত্ত এদের গানও ভালো লাগত তার। একটি স্মৃতি তাকে বেশ আলোড়িত করে- ১৯৭২ সালের কথা, বোম্বেতে গানের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইছি, শ্রোতা হিসেবে আছেন এসডি বর্মণ, অমিতাভ বচ্চন, জয়া ভাদুড়ি, রাজকুমারসহ আরও অনেকে। হঠাৎ দেখি লতা মুঙ্গেশকর ঢুকছেন। তাকে দেখে ভয় পেয়ে হারমোনিয়াম বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছি। সবাই আবার জোর করে ধরে বসিয়ে দিলেন। শচীন দেব অনুরোধ করলেন ‘নাইয়ারে নাওয়ের বাদাম তুইলা’ গানটির জন্য। সেদিন লতা মুঙ্গেশকর উঠে এসে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। দিনটি আমার জন্য এখনো বিশেষ কিছু।’ সাবিনা ইয়াসমিনের গানের ভুবনে বিচরণ দীর্ঘদিনের। কথায় কথায় তিনি বলতে সুরে করলেন ভালোলাগা কিছু গানের কথা। ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাক’ আমার খুব হৃদয়ছোঁয়া একটি গান। করাচির ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য ১৯৬৯-৭০ সালে এ গানটি করাচির একটি স্টুডিওতে রেকর্ড করেছিলাম। গানটি লিখেছেন নঈম গওহর। সুর করেছেন আজাদ রহমান।’ জানালেন, গানটি তিনি রেকর্ড করেন নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে। ওই সময় এইচএমভি থেকে দুটি গানের একটি রেকর্ড বের হয়। যেখানে প্রথম গানটি ছিল সমবেত কণ্ঠে গাওয়া ‘পুবের ওই আকাশে সূর্য উঠেছে আলোকে আলোকময়’। তার সঙ্গে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’ গানটি সংযোজিত হয়। এ গান পরবর্তী সময়ে কাজী হায়াতের ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিতে ব্যবহার করা হয় সাবিনার কণ্ঠে। আর ‘ও আমার বাংলা মা তোর’ গানটি আলাউদ্দিন আলীর সুর করা। গানটির কথা লিখেছেন আবুল ওমরাও মো. ফখরুদ্দিন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দীর্ঘ সময় নিয়ে গানটি লিখেছিলেন তিনি। এ গানটি ১৯৭২ সালে করা। প্রথম গানটি রেকর্ড করা হয় ডিআইটি টিভি ভবনে। মূলত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র ‘এক ঝাঁক বলাকা’-এর জন্য গানটি সাবিনা গেয়েছিলেন। সংগীত পরিচালক হিসেবে আলাউদ্দিন আলীর এটি প্রথম ছবি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি হয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় গানটি আবার রেকর্ড করা হয় বিটিভির জন্য। ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার’ গানটির অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় একটি গান। এ গানটি ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য করা। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ সালে করা। গানটি সুর করেছেন অজিত রায় আর লিখেছেন প্রয়াত নজরুল ইসলাম বাবু। ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে মাঝি পাল উড়াইয়া দে’ গানটি সাবিনা ইয়াসমিনের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। বললেন, প্রয়াত এসএম হেদায়েতের কথা ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে গানটি যখন রেকর্ড করা হয়, তখন আমার ছেলে শ্রাবণ গর্ভে। ওকে নিয়েই গানটি করি। সেটা ছিল অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা।’ এ কথা বলতে বলতে সাবিনা ইয়াসমিন যেন ফিরে গেলেন সেই দিন, সেই ক্ষণে। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘১৯৮২ সালের দিকে ২৬ মার্চ বিটিভির বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য নজরুল ইসলাম বাবুর কথা এবং আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে গাই ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানটি। মনে আছে, ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটি রেকর্ড করা হয়েছিল। গানটি টানা আট-নয় বছর বিটিভির খবরের আগে ও পরে বাজানো হয়েছে।

সাবিনা ইয়াসমিন সুযোগ পেয়েছেন উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আরডি বর্মণের সুরে গান গাওয়ার, বিখ্যাত কিশোর কুমারের সঙ্গেও ডুয়েট গান গাওয়ার। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তানে তিনি অনেকবার গান করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গান করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘উল্কা’ নামের সিনেমাতে অভিনয়ও করেছেন তিনি।

সাবিনা ইয়াসমিন তার গানের এই জীবনের জন্য খান আতাউর রহমানের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেন। বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমারের সঙ্গেও ডুয়েট গান করেছেন। সাবিনা ইয়াসমিনের প্রিয় সংগীতশিল্পী মেহেদি হাসান, শাহনাজ রহমতউল্লাহ ও রুনা লায়লা। প্রিয় গান শ্যামল মিত্রের ‘তুমি কি এমনি করে থাকবে দূরে’। নায়িকার হাতের প্রক্সি হিসেবে ‘মনের মতো বউ’ ছবিতে ‘এ কি সোনার আলোয়’ গানে পিয়ানো বাজানোর দৃশ্য খান আতা শুট করেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে।

এ গান নিয়েই শোনালেন মজার এক অভিজ্ঞতা। অভিনেত্রী অঞ্জনা আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন অঞ্জনা বেড়াতে গেছেন সারাদিনের জন্য। দুপুরে খাওয়ার পর দুজনে বাগানে হাঁটছিলেন। অঞ্জনা অনুরোধ করলেন সাবিনাকে গান গাওয়ার জন্য। সাবিনা গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলেন। তার গান শুনে বাইরে থেকে একজন পথচারী মন্তব্য করে বসে-এহ্, সাবিনা ইয়াসমিন হইবার চায়। সে কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। ভক্তদের নিয়ে নিশ্চয় অনেক স্মৃতি আছে আপনার? এমন কোনো ভক্তের স্মৃতি কি মনে পড়ে? তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘এক ভক্ত একবার বললেন, ওনার চেয়ে বড় ভক্ত আমার আর নেই। বললাম, ঠিক আছে ভালো। মাঝেমধ্যে ফোন করেন, কী গান করলাম, ফাংশনে কোথায় যাচ্ছি-এসব গল্পটল্প হতো। কোরবানির ঈদের কিছুদিন আগে তিনি বললেন, ম্যাডাম আমি আপনাকে কিছু একটা দিতে চাই। না, না, কিছু দিতে হবে না। কিছুতেই শোনেন না। বললাম, একদম লাগবে না। কিছুই দরকার নেই। ঈদের দিন সকালে, সাড়ে ৬টা-৭টা হবে, কলিং বেল শুনে আমার কাজের মহিলা গিয়ে দরজা খুললেন। কী ব্যাপার? একটা ছেলে আমাকে খুঁজছে। বললেন, উনি তো ঘুমাচ্ছেন। কী ব্যাপার? বলল, অমুক স্যার ওনার জন্য একটা উপহার পাঠিয়েছেন। তো বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। (হাসি) ছেলেটার হাতে একটা দড়ি। বিশাল একটি গরু নিয়ে এসেছে। (হাসি)।

মাঝখানে কঠিন একটা অসুস্থতাকে জয় করতে হয়েছে এ গুণী শিল্পীকে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। মানুষের দোয়ায়, তোমাদের সবার দোয়ায়, মা-বাবার দোয়ায়, সবার আশীর্বাদে ভালো আছি।

সর্বশেষ খবর