শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

তারেক মাসুদ ঝরে যাওয়া এক প্রস্ফুটিত ফুল

পান্থ আফজাল

তারেক মাসুদ ঝরে যাওয়া এক প্রস্ফুটিত ফুল

জন্ম : ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬-মৃত্যু : ১৩ আগস্ট ২০১১

‘পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী’- এটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মহাশূন্যতায় সবাই উপলব্ধি করেছেন এবং এখনো করছেন। এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় এই প্রস্ফুটিত সৌরভময় ফুল ঝরে গেলেন। ২০১১ সালে ১৩ আগস্ট স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘কাগজের ফুল’র শুটিং লোকেশন দেখে ঢাকায় ফেরার পথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তারেক মাসুদের মাইক্রোবাস ও একটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই দুর্ঘটনা ঘটে। মুহুর্তের দুর্ঘটনায় তিনি নিজেই ‘মৃত্যুর ফুলের’ মতো হয়ে গেলেন কাগজের খবর। নির্মাতা তারেক মাসুদের সঙ্গে পরপারে পাড়ি জমালেন দেশের অন্যতম চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। আরও নিহত হন তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের প্রোডাকশন সহকারী ওয়াসিম, জামাল এবং মাইক্রোবাসের চালক মোস্তাফিজুর রহমান। বেঁচে থাকলে আজ ৬৫ বছরে পা রাখতেন গুণী এই নির্মাতা। এই সিনেমাযোদ্ধা আমেরিকায় বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ‘আদম সুরত’, ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘মাটির ময়না’, নরসুন্দর, ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘রানওয়ে’, ‘আ কাইন্ড অব চাইল্ডহুড’, ‘নারীর কথা’সহ আলোচিত কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলা সিনেমায় নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন তারেক মাসুদ। তারেক মাসুদ ১৯৮২ সালে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে প্রখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর ‘আদম সুরত’ নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনি। এটি নির্মাণ করতে তাঁর লেগেছিল সাত বছর। ১৯৯৬ সালে তিনি নির্মাণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে ‘মুক্তির গান’। ১৯৭১ সালে মার্কিন নির্মাতা লেয়ার লেভিনের ক্যামেরাবন্দী ফুটেজের সঙ্গে বিভিন্ন  ফুটেজ দিয়ে এই ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য তিনি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ২০০২ সালে তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’ মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘মাটির ময়না’ ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইটের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে ফিপরেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচকদের পুরস্কার লাভ করেছিল। ৭৫তম একাডেমি পুরস্কার অনুষ্ঠানে এটি ছিল শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাংলাদেশের নিবেদিত প্রথম চলচ্চিত্র। ২০০৪ সালে চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিল। ২০০৬ সালে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছিলেন ‘অন্তর্যাত্রা’ এবং ২০১০ সালে নির্মাণ করেছিলেন ‘রানওয়ে’। তাঁর শেষ ও অসম্পূর্ণ কাজ ছিল ‘কাগজের ফুল’; একটি অসম্পূর্ণ বাংলাদেশি মহাকাব্য নাট্য চলচ্চিত্র। এটি তারেক মাসুদের বাবার জীবন অবলম্বনে নির্মিতব্য চলচ্চিত্র। নির্মাতার গল্প অবলম্বনে যৌথভাবে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন তারেক এবং ক্যাথরিন মাসুদ। তাঁর মৃত্যুর পর এই ছবিটির নির্মাণকাজ থেমে রয়েছে। বেশ কয়েকবার শুরুর কথা শোনা গেলেও প্রায় ১১ বছর ধরে কোনো আপডেট নেই ছবিটির। তাহলে কি ছবিটি আর হচ্ছে না? তবে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এই অসমাপ্ত কাজটি শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান ক্যাথরিন মাসুদের সহকারী নাহিদ। তিনি বলেন, ‘তারেক ভাইয়ের এই স্বপ্নের প্রজেক্টের কাজ শেষ করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’ তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পর থেকে ছবিটির যাবতীয় কাজ দেখাশোনা করছেন তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। ক্যাথরিন মাসুদ বর্তমানে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াচ্ছেন। ‘কাগজের ফুল’ ছবিটি ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে ৩৫ লাখ টাকা পেয়েছিল। তারেক মাসুদ দেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন শর্টফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। তারেক মাসুদ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ‘কাগজের ফুল’ ফোটাতে কাজ করে গেছেন নিরন্তর; মরে যায়নি তাঁর সেই স্বপ্ন। তিনি জীবন্ত ফুল হয়ে ফুটে রয়েছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মানসপটে।

 

তারেক মাসুদ স্মরণে আয়োজন

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের দশম প্রয়াণ দিবস আজ। দিনটিকে সামনে রেখে ‘কথাপ্রকাশ’ থেকে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’র বর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ হতে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের লিখিত বহু চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধের মধ্য হতে পূর্ব-প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত ৩৩টি প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত ও সম্পাদিত হয়েছে ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’। চলচ্চিত্র বিষয়ক ৩৩টি প্রবন্ধকে মোট আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ যৌথভাবে সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ক্যাথরিন মাসুদ, নাহিদ মাসুদ, প্রসূন রহমান ও বেলায়াত হোসেন মামুন। এদিকে আজ প্রয়াণ দিবসে ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি এবং তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট যৌথভাবে এক আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। ‘তারেক মাসুদ স্মারক বক্তৃতা ২০২১’ শিরোনামের এই আয়োজনে বক্তৃতা প্রদান করবেন চলচ্চিত্র শিক্ষক, লেখক ও চলচ্চিত্র তাত্তি¡ক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। করোনার কারণে এ আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্জালে আজ রাত ৮টা ৩০ মিনিটে ম্যুভিয়ানা সোসাইটির ফেসবুক পেজ থেকে।

সর্বশেষ খবর