বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : আবুল হায়াত

সে যাত্রায় আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই

সে যাত্রায় আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল উত্তাল। গোটা দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্দেশক আবুল হায়াত।  সে সময়কার স্মৃতি রোমন্থন ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন ব্যস্ততা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

শুনেছি অসুস্থ ছিলেন শরীর এখন কেমন?

শরীর মোটামুটি ভালো আছে। স্ট্যাবল অবস্থায়। তবে চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে নিয়মিত কাজকর্ম সবই করছি। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

 

অসুস্থ শরীর নিয়েও শুটিং করছেন...

কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কাজ করছি। তবে হুড়োহুড়ি করে কাজ করছি না। প্রতিদিন করতেও চাই না। ধীরে ধীরে কাজ করব। এই তো ২৮ তারিখ থেকে দুরন্ত টিভির সিরিয়ালের শুটিং শুরু করব। কিছুদিন আগে একটি এক ঘণ্টার নাটক নির্মাণ করলাম। নাম ‘এসো শ্যামল সুন্দর’। আর ছোটখাটো কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করেছি; অভিনয়ও করছি। বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছি, তবে কমফোর্ট অনুভব হলেই করছি।

 

প্রতি বছরের মতো এবারের বইমেলায়ও আপনার লেখা বই বের হচ্ছে সবকিছু কি প্রস্তুত?

প্রস্তুত বলা যায়। প্রচ্ছদ কভারও হয়ে গেছে। প্রচ্ছদ করেছে বিপাশা। বইয়ের নাম ‘রঞ্জিত গোধূলি’। দুটি বড় গল্প নিয়ে এই উপন্যাসটি। বইটি প্রিয় বাংলা প্রকাশন থেকে প্রকাশ হবে। আসলে আমি প্রতি বছর বইমেলায় একটি করে বই প্রকাশ করি।

 

মঞ্চে নিয়মিত না হওয়ার কারণ কী?

বিভিন্ন ব্যস্ততায় মঞ্চে এখন নিয়মিত কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

মহান বিজয়ের মাস চলছে এই বিশেষ দিবসটি নিয়ে অনুভব কী?

সাংঘাতিক অনুভব! এটা তো হৃদয়ে ধারণ করেছি। নিজের চোখে দেখেছি। রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। সে সময় দেখেছি লাখো জনতার উদ্বেল, উচ্ছ্বাস। বিজয় আমার কাছে জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা একটু খুলে বলবেন কি?

তখন আমি ঢাকা শহরে ছিলাম। তবে, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করিনি। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা এলে তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর জানতাম, খোঁজ নিতাম। মূলত তারাই আমাকে দেশের সব অবস্থার কথা বলত। আমি মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত একটানা অসুস্থ ছিলাম। ভর্তি হলাম হাসপাতালে। আমি ২৩ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত কোমায় ছিলাম। আর এই অসুস্থতা থাকা অবস্থায়ই আমার প্রথম সন্তান বিপাশার জন্ম। সেই সময় স্বাধীনতার যুদ্ধ চরম রূপ ধারণ করে। তবে বাচ্চার জন্ম ও অসুস্থ থাকার কারণে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তখন গ্রামে ছিলাম। বাকি সময় ঢাকায়ই ছিলাম। তবে ৬৯, ৭০ ও ৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কিন্তু আমরা দল বেঁধে নাটক করেছি। সে সময় সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সবাই যুক্তও ছিলাম। সবাই মিলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি।

 

অলৌকিকভাবে তো একবার বেঁচেও গিয়েছিলেন...

দুবার মিলিটারি রেট করেছিল। এরমধ্যে একবার মিলিটারিরা আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবে সে যাত্রায় আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই। সেটা ডিসেম্বরের ১ তারিখের কথা।

 

সেই উত্তাল সময়ে নাট্যবিপ্লবের সঙ্গে কে কে সম্পৃক্ত ছিলেন?

সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে এ দেশের অনেক শিল্পীই যুক্ত ছিলেন। তবে, আমার সম্ভব হয়নি ওখানে কাজ করার। আমি তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল অনেক দূরে। তবে আমি অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে সে সময় কাজ করেছি। সবাই সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ, সৃজনী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী এবং আমরা কজনা- এই তিন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ঢাকার রাস্তায়, শহীদ মিনার, জগন্নাথ হলসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আমরা অনেক মুক্তিযুদ্ধের নাটক, পথনাটক ও কোরাস গান করেছি।

 

কোন ধরনের নাটক তখন বেশি করতেন?

তখন তো নাটক দিয়েই আমাদের আন্দোলন চালিয়েছি। মূলত সব নাটকই ছিল সংগ্রাম ও বিপ্লবকে উপলক্ষ করে। একসময় পাকিস্তানি শাসকরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক নিষিদ্ধ করে। কিন্তু আমরা সেই নিষেধ অমান্য করে ঢাকার মাঠে-ঘাটে, হলে, শহীদ মিনারে, ট্রাকে নাটক করেছি। সে সময় করেছি রক্তকরবী, বৈকুণ্ঠের উইল, রক্ত দিলাম স্বাধীনতার জন্য, চাঁদ উঠবে এখনই, আর্বতনসহ প্রচুর নাটক। বিপ্লব ও সংগ্রাম উপজীব্য এই নাটকগুলো আমরা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছি। তখন একেকটা নাটকের ব্যাপ্তি কখনো ছিল ৩০ মিনিট, কখনো ১ ঘণ্টার বা তারও বেশি। হাসান ইমাম ভাই আমাদের দলের প্রধান ছিলেন। তাঁর পরিচালনায় আমরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে, পথে-ঘাটে, মঞ্চে দল বেঁধে নাটক করতাম। আর আমাদের গানের গুরু ছিলেন আমরা কজনার আরিফুল হক ভাই। আমরা ঢাকার এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে ঘুরে এসব নাটক প্রদর্শন ও কোরাস গাইতাম।

 

স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে?

এখনো আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তথ্য উদ্ধারে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো অনেক কিছু জানার বাকি আছে। এসব তথ্য উদ্ধারে কেউ প্রপারলি কাজ করছেন কি না তা আমার জানা নেই। তবে আমার জানা মতে, রশিদ হায়দার ভাই কাজ করছেন। আর বাংলা একাডেমিসহ অনেকেই এখন কিছুটা কাজ করছে। সে সময়কার কিছু কাজ, প্রযোজনা ছিল, যা এখন প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশার কথা যে, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সঠিক তথ্য প্রকাশে কাজ করছে। তবে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর তথ্য নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আমি মনে করি, আর এসব বিষয় নিয়ে বর্তমান প্রজন্ম জোরালোভাবে এগিয়ে আসবে।

 

স্বাধীন দেশের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

অনেক কিছুই পেয়েছি। দেশ পেয়েছি, একটি পতাকা পেয়েছি। আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা পেয়েছি। এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না।  এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। আমি এই স্বাধীন দেশে বসবাস করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।

সর্বশেষ খবর