একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান। টিভি নাটকেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন। এই প্রয়াত কিংবদন্তিকে নিয়ে লিখেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
জীবনে মজার যত ঘটনা
ভালো-মন্দ দুই ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন তিনি। মন্দ চরিত্রে অভিনয় এমনভাবে বিশ্বাসযোগ্য হতো যে, মাঝে-মধ্যে তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। একবার জুমার দিনে গোসল করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যখন মসজিদে যাচ্ছিলেন তখন এক লোক এ টি এম শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন? এ টি এম বললেন, মসজিদে যাচ্ছি। লোকটি বললেন, জুমার নামাজ পড়ে আপনার লাভ কি? জীবনে এত আকাম করেছেন বুঝতে পারছেন না? আপনি একটা বাজে লোক।’ ‘সিনেমায় আমাকে দেখে তারা খারাপ ভেবেছে, এতেই আমার আনন্দ’- এ টি এম শামসুজ্জামান এক সাক্ষাৎকারে কথাটি বলেছিলেন। পর্দায় তাঁর অভিনয় দেখে দর্শক কখনো হেসেছে, কখনো কেঁদেছে। আর এখানেই একজন অভিনেতার সার্থকতা। এমনটাই মনে করতেন এই অভিনেতা। একবার এক গ্রামে শুটিং করতে গেছেন তিনি। ভোরবেলায় পুকুরপাড়ে হাঁটছিলেন। এক মহিলা পুকুর থেকে কলসে পানি ভরে নিয়ে পুকুরঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এ টি এমের সামনে পড়তেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘ও আল্লাগো এই শয়তান ব্যাডা এইহানে কী করে’- বলতে বলতেই ভয়ে কলস ফেলে উঠে এক দৌড়। এ টি এম মুচকি হাসলেন ও তৃপ্তি পেলেন এই ভেবে, ‘পর্দায় আমার খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করা তাহলে সার্থক হয়েছে।’ স্কুলে পড়ার সময় এ টি এম শামসুজ্জামান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সান্নিধ্য পান। নানা-নাতির সম্পর্ক ছিল দুজনের। বালক এ টি এম একবার নানাকে জব্দ করার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন, ‘নানা, আপনি এতগুলো সন্তান নিয়েছেন কেন?’ প্রশ্ন শুনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি একজন রবীন্দ্রনাথের অপেক্ষায় আছি।’ স্কুলজীবনে এ টি এম শামসুজ্জামানের বন্ধু ছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী। রফিকুন নবী প্রায়ই বলতেন, ‘কাল স্কুলে আসার সময় মাথায় তেল দিয়ে আসিস।’ বন্ধুর কথামতো এ টি এম মাথায় তেল দিয়ে স্কুলে আসতেন। খাতার সাদা পাতা রফিকুন নবী এ টি এমের তেল-মাথায় ঘষে নিতেন। তারপর ওই পাতায় তিনি ইচ্ছামতো ছবি আঁকতেন। পাড়ায় নাটকের মহড়া হচ্ছে। অনেক মানুষের ভিড়। কিন্তু বালক এ টি এম শামসুজ্জামানকে কেউ ঢুকতে দিচ্ছে না। একদিন বুদ্ধি করে তিনি নাটকের শিল্পীদের চা খাওয়ানোর কথা বলে চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকে পড়লেন মহড়াকক্ষে। একদিন এক কান্ড হলো- প্রমোটার আসেননি। এই সুযোগটি নিলেন এ টি এম শামসুজ্জামান। প্রমোটারের কাজ শুরু করলেন। হয়ে গেলেন নাটকের একজন। চলচ্চিত্রে কাজের আশায় এ টি এম শামসুজ্জামান পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর কাছে এসেছেন। তিনি ৫০০ পৃষ্ঠার একটি পান্ডুলিপি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি তিনটি কপি করে নিয়ে এসো। এ টি এম রাত জেগে খুব খেটে ১২ দিনের মধ্যেই তিনটি কপি করে জমা দিলেন। উদয়ন চৌধুরী দেখে প্রশংসা করে বললেন, দারুণ হয়েছে! তারপর তিনটি পান্ডুলিপিই তিনি ময়লার বাক্সে ছুড়ে ফেলে দিলেন। এ টি এম অবাক। উদয়ন চৌধুরী বললেন, আমি তোমার ধৈর্যশক্তির পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। তুমি পরীক্ষায় পাস করেছ। তুমি এখন থেকে আমার তিন নম্বর সহকারী। সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন শুনেই এ টি এম শামসুজ্জামানের বাবা প্রচন্ড রেগে গেলেন। ফল হলো ভয়াবহ। তিনি ছেলেকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। তাতে অবশ্য ছেলের মন খারাপ হলো না। তিনি কাপড়-চোপড় নিয়ে সোজা চলে গেলেন উদয়ন চৌধুরীর কাছে।
সব চরিত্রেই সফলতা
এ টি এমের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে তিনি একই সঙ্গে সিরিয়াস অভিনয় যেমন পারতেন, তেমনি সিরিয়াসনেসের ভিতরেও কমেডি ঢুকিয়ে দর্শক হাসাতে পারতেন। এমন ছবি আছে তিনি ভয়ংকর ভিলেন যেমন- চেতনা, বদসুরত; আবার এমন ছবি আছে তিনি সরল-সোজা যেমন- দায়ী কে; আবার এমন ছবিও আছে নিখাদ কমেডিয়ান যেমন- মোল্লাবাড়ির বউ। এ ধরনের কম্বিনেশন একমাত্র তাঁর মধ্যেই ছিল। দেশীয় ছবির আশির দশকের বিখ্যাত পত্রিকা ‘চিত্রালী’তে একটা লেখা ছাপা হয়েছিল তখনকার ব্যস্ত শিল্পী এ টি এমকে নিয়ে। বলা হয়েছিল- ‘এ টি এম ছাড়া ছবি জমে না।’ তাঁকে তুলে ধরার অল্প কথায় এটাই ছিল যথার্থ উপায়। আর ছবি জমানোর বিষয়টা তাঁর মাল্টিডাইমেনশনাল ক্যারেক্টার প্লে করার দক্ষতা থেকেই বলা হয়েছিল। মূল খলনায়ক হয়ে যেমন পর্দা কাঁপিয়েছেন আবার সহখলনায়ক হয়েও ‘ঘৃণা’র মতো ছবিতে নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। কমেডিতে তাঁর জুটি ছিল হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে। ‘ভ-’ ছবিতে তাঁর ২০ বছরের মুরগি চুরির অভিজ্ঞতার অভিনয় কে ভুলতে পারে!
জীবনচিত্র
২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পরপারে চলে যান। মূল নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, নোয়াখালীতে। স্কুলে তাঁর বন্ধু ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীর মিত্র। মঞ্চে কাজ করতেন ছাত্রজীবন থেকে। অভিনয়টা সে জন্যই রক্তে মিশে গিয়েছিল তাঁর। সর্বশেষ অভিনীত ছবি ‘আলফা’।