‘কোকিলকণ্ঠী’-খ্যাত গায়িকা বেবী নাজনীন। যিনি দেশীয় বিনোদন জগতের ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ হিসেবেও সুপরিচিত। নব্বই-পরবর্তী আধুনিক বাংলা গানের ভুবন যার স্বরগ্রামের সঙ্গে উঠত-নামত, এই তারকাশিল্পী তাঁদের অন্যতম। ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। একপর্যায়ে কোণঠাসা হয়ে পাড়ি জমান বিদেশে। দীর্ঘ আট বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের প্রবাসজীবন কাটিয়ে সম্প্রতি নতুন বাংলাদেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরার কিছুদিন পর এই তারকার সঙ্গে জানা-অজানা নানা প্রশ্ন নিয়ে মুখোমুখি- পান্থ আফজাল
নতুন দেশে ফিরে কেমন লাগছে?
আলহামদুলিল্লাহ! আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি। খুব ভালো লাগছে।
এমন বাংলাদেশই কি চেয়েছিলেন?
নতুন দেশ চেয়েছিলাম। তবে এত ত্যাগের বিনিময়ে চাইনি। এতগুলো ত্যাগ, এতগুলো প্রাণ চলে গেছে। এমনি-ই তো হতে পারত! সুন্দর একটি দেশ হতে পারত। তবে সত্যি যা পেয়েছি, অসাধারণ এই স্বাধীনতা। বলা যায়, নতুন করে বাঁচা। যদিও কষ্ট রয়েছে, খুব কষ্ট। আনন্দ লাগলেও তার চেয়ে কষ্টটা অনেক বেশি। স্বাধীনতা চেয়েছি কিন্তু এত প্রাণের বিয়োগ চাইনি। সেজন্য যা পেয়েছি স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা, শুকরিয়া। যেন আমাদের এই স্বাধীনতা আমরা দেশবাসী-জাতি সবাই মিলে ধরে রাখতে পারি এবং নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি, নতুন প্রজন্মের জন্য।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর দেশের সবকিছুর সংস্কার হচ্ছে। সেই হিসেবে সংগীতজগতের সংস্কার কেমন হওয়া উচিত?
আমার যদি সৌভাগ্য হয় সাজানোর, তাহলে আমি ঢেলেই সাজাব। ঐতিহ্যকে তুলে নিয়ে আসব। দেশের পরিচয়কে তুলে নিয়ে আসব। দেশের আইডেন্টিটিকে তুলে নিয়ে আসব। দেশের শিল্পীদের মেধাকে মূল্যায়ন করে যোগ্যতা অনুযায়ী অবস্থান নির্ধারণ করব। শিল্পীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করব। তারা যেন এ দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারেন। সেই শক্তিটুকু দিয়ে তাদের তৈরি করব। এটা খুবই জরুরি এবং দেশের সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফরমটাকে ক্রেডিবল, হেলদি এবং পারমানেন্ট করা দরকার।
দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, কেন? কী ঘটেছিল সে সময়?
প্রথমত আমাকে হ্যারেজ করা হয়; অ্যারেস্ট করা হয়। আমার ফাইন্যান্সিয়াল ডিপার্টমেন্টকে সম্পূর্ণভাবে ব্লক করে দেওয়া হয়। সে সময় আমাকে মানসিকভাবে ভীষণ হেয় করা হয়। যেন আমি আমার রেসপেক্ট নিয়ে, যোগ্যতা নিয়ে বেঁচে থাকতে না পারি। এরকম অনেক প্রতিবন্ধকতা করা হয়েছিল আমাকে।
সংগীতাঙ্গনে আপনাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল...
বিষয়টি ভীষণ অমানবিক! টিভি, বেতার, সিনেমায় আমাকে গান গাইতে দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ ১৬ বছর গাইতে পারিনি।
এখনকার শিল্পীদের সঙ্গে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হবে কি?
এমন কিছুই থাকবে না; ঘটবে না। সব সময় একই জীবন চলে না। সারা পৃথিবী উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশ কেন পড়ে থাকবে? আমাদেরও উন্নয়ন হবে। শিল্পীসহ সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরের উন্নয়ন হবে, এটা বিশ্বাস করি।
যে প্রবাস জীবন এতদিন যাপন করেছেন, সেটা কেমন ছিল? নিজের দেশ আর মায়ের কোল সমান। মায়ের বুকে জড়িয়ে থাকা আর নিজের দেশে থাকা এটা কিন্তু একই বিষয়। বিদেশ উন্নত দেশ বলে সেখানে কোনো অসম্মানের জায়গা নেই। সেখানে শিল্পীদের সম্মান করা হয়। তারা তো জাতিগতভাবেই প্রচণ্ড সম্মানী। তারা সম্মান দিতে ভালোবাসে, সম্মান নিতে ভালোবাসে। এর মাঝখানে আর কিছু নাই। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা যায় সেখানে। করেছিও সেখানে। স্টেজ শো, গান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করেছি। শুধু ওখানে রেকর্ডিংটা করতে পারিনি। রেকর্ডিং করতে গেলে একটা ভালো স্টুডিও দরকার, যেটা ওখানে খুবই কস্টলি। আর আমেরিকানরা তাদের মতো করে রেকর্ডিং করে।
গান নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা কী?
আমি তো গানের মানুষ। আধা করা কাজ যেগুলো রয়েছে সেগুলো আমি কমপ্লিট করব। তারপর দেখা যাবে, ইনশাআল্লাহ!
‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামটি যিনি দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে আপনার দারুণ সখ্য ছিল। নামটার নেপথ্যের গল্পটা একটু বলবেন?
‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামটি কি ভালো লাগে না? আমার শ্রোতা-দর্শক, ভক্তরা এই ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ নামটি খুবই পছন্দ করে। আই লাভ ইট। খুবই ইনজয় করি নামটি। জানেন তো, ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ ইজ দ্য রেয়ার স্টোন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। আগে তো শুধু একটাই ছিল। তো এই জিনিসটা মানুষের ভালোবাসা। আর ভালোবাসাটাকে স্পেশাল রাখার জন্য, একটু কালো বলে আমাকে মনে হয় একটু স্যাটিসফাইড করার জন্য ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ বলা হয়। আমার দেশের মানুষ, দেশের জনগণ আমাকে একেক সময়, একেক নাম দিয়েছে। আমার শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত, আমার সত্যিকার অর্থে একটা শ্রদ্ধার জায়গা, বিনম্র শ্রদ্ধার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্নেহ করে আমাকে অনেকবার অনেক নামে ডেকেছেন। সেগুলো একটা একটা করে শ্রোতারা যেন কোথা থেকে পেয়ে যায়! তখন তারা ডাকা শুরু করে।
আপনাকে সে সময় হেলিকপ্টারে নিয়ে এসেছিলেন তিনি...
হ্যাঁ। (মৃদু হাসি)
অনেক কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? তিনি কেমন মানুষ ছিলেন?
উনি এত বড় মাপের মানুষ। তিনি বিশাল একটা ইনস্টিটিউশন। সে সময় সার্ক কালচার অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশের কালচারাল এক্সচেঞ্জগুলো তিনিই করেছিলেন। তিনি কিন্তু তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, আমরা কোনো একটা সময় এই ১৬ বছরের মতো একটি কালো সময় পার করব। সেজন্য তিনি অনেক কিছু করেছিলেন। সেগুলো যদি ভালোভাবে পালন করা হতো, তাহলে বোধহয় আমাদের উত্তরণ সম্ভব ছিল। তিনি সাহিত্যিক, কবি, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, পেইন্টার- সব আর্টিস্টকে রেসপেক্ট করতেন, উৎসাহ দিতেন, ভালোবাসতেন। ফলশ্রুতিতে অনেক ভালো শিল্পী তৈরিও হয়েছিল। সে সময়ের সংস্কৃতিচর্চা তো এখন আর নেই; প্ল্যাটফরমও নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও নেই। কিন্তু তিনি তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। সেই আদর্শ আমরা যারা লালন করি। এসব নিয়ে ভাবি। জানি, নিশ্চয়ই এর থেকে উত্তরণ আমাদের এক দিন হবে। আমরা সেই পথেই চলব, ইনশাআল্লাহ!
এবার তাহলে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হবেন?
আশা করতে তো দোষ নেই। স্বপ্নই যদি দেখব, তো ভালোটাই দেখব। স্বপ্নটা এরকম, দেশের জন্য এখনকার বাস্তবতা যেটা পথচলা, সেই পথ কিন্তু আমি চলছি। বিএনপির সঙ্গেই কিন্তু আমি বেড়ে উঠেছি। সেজন্য মনে করেন, বিএনপি একবার করেছিল, আবারও করবে। ভালো কাজগুলো এখন করছি বেশি করে। আমি মনে করি, এক দিন সাংস্কৃতিক অঙ্গনটা খুবই শক্তিশালী হবে।
‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’- গানটি আপনি মনে-প্রাণে ধারণ করেন, যেটি বিএনপির দলীয় গানও। এটিকে আরও বেশি বিস্তৃত করতে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি?
গানটি নিয়ে আমার সামনে সুন্দর কিছু প্ল্যান আছে। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু করেছি। আশা করছি, ভালো কিছুই হবে। এ গানটির কথাগুলো মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা। তিনি এত বছর আগে এত চমৎকার করে গানটি লিখেছেন, সত্যিই অতুলনীয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবনের সঙ্গে কীভাবে একটি গানের লাইনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশের প্রতিটি স্তরে স্তরে থাকা বিষয়গুলো এ গানের প্রতিটি লাইনে রয়েছে। এটির মধ্যে বলা যায় পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশ রয়েছে। এটির সুর দিয়েছিলেন বিখ্যাত সংগীত পরিচালক প্রয়াত আলাউদ্দিন আলী এবং গেয়েছেন অতুলনীয়, আমার শ্রদ্ধাভাজন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। তাঁর নাম আসলে মনে কষ্ট জেগে ওঠে। চোখটা জলে ভরে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়নি। দলের কথা রাখেন, আপনি যদি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ নিয়ে একটি ছবি আঁকেন তাহলে দেখবেন এই গানটিই পুরো একটি ছবির বাংলাদেশ। এটি জাতির সঙ্গে আলাদা হবে কীভাবে! তাই এ গানটি জাতীয়তাবাদী দলের দলীয় সংগীত। কারণ, জিয়াউর রহমান এ গানটিকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান এ গানটি দিয়ে শুরু করতেন। মিটিং শুরু করতেন, আবার শেষটাও এ গানটি দিয়ে করতেন। তিনি নিজেও আমাদের সঙ্গে এসে দাঁড়িয়ে গানটি গাইতেন। আমার সঙ্গে কতবার যে এ গান গেয়েছেন। ম্যাডামও গেয়েছেন। এ গানটি আমি অনেকবার গেয়েছি।
শিল্পীদের রাজনীতিতে যুক্ত থাকা কি সমর্থন করেন?
রাজনীতি তো একটা বড় সংস্কৃতি। কেন সমর্থন করব না। এটিকে পজিটিভলি দেখতে হবে সবার। শিল্পীরা কি রাজনীতি করতে পারবেন না? শিল্পীরা বরং আরও ভালো পারবেন।