একটা সময় ছিল, সন্ধ্যা নামলেই দেশের ঘরে ঘরে বাজত একটাই সুর, টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিন! কারণ, বিটিভিতে নাটক শুরু হতে যাচ্ছে। আর নব্বইয়ের দশকের সেই অদ্ভুত মায়াবী সন্ধ্যাগুলোতে যাদের নাম শোনা যেত প্রায় ঘরে ঘরে, তাদের একজন খালেদ খান। ‘ছি ছি ছি, তুমি এত খারাপ!’-এই সংলাপ শুনেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘রূপনগর’-এর সেই নরম চেহারার কঠিন মানুষটা, হেলাল। তার খলচরিত্র এতটাই জীবন্ত ছিল যে, মানুষ ভয় পেত, ঘৃণা করত, আবার ঠিক একই সময়ে পর্দায় চোখ রাখত অবিরাম।
হেলাল না, যুবরাজ
যে মানুষটি হেলালের মতো চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মনে ঘৃণার অনন্ত বীজ বুনে দিতে পারেন, তিনি যে আসলে অভিনয়ের রাজপুত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, খালেদ খান, যার ডাকনামই ছিল ‘যুবরাজ’। তিনি ছিলেন একাধারে মঞ্চের মানুষ, টেলিভিশনের মানুষ, আর মানুষও ছিলেন দারুণ সহজ-সরল, প্রচারবিমুখ এক শিল্পী। তার হাসির ভিতর ছিল মঞ্চের আলো, তার চোখের চাহনিতে ছিল অদ্ভুত এক গভীরতা।
খল থেকে জাদুকর
‘রূপনগর’-এর হেলালের ঠিক বিপরীতে ভাবুন তো ‘এই সব দিনরাত্রি’-এর সেই রহস্যময়, কৌতূহলী, অদ্ভুতভাবে আপন হয়ে যাওয়া মানুষটা, জাদুকর আনিস! কিংবা ‘কোন কাননের ফুল’-এর ‘বুড্ডা’! খালেদ খানের ক্যারিয়ারে এমন বৈচিত্র্যময় চরিত্রের ছড়াছড়ি, যেখানে তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, আবার ভেঙেছেন। দর্শকদের সামনে নিজেকে প্রতিবারই নতুন করে হাজির করেছেন।
মঞ্চে যার শেকড়, টিভিতে যার রাজত্ব
তার মঞ্চযাত্রা শুরু নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ দিয়ে। এরপর ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘রক্তকরবী’তে তিনি চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। বিশু পাগলা নামটা তো আজও মঞ্চপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে! আর টিভিতে? কোথা থেকে শুরু করবেন! ‘সিঁড়িঘর’, ‘একা একা’, ‘ফেরা’, ‘ওথেলো ও ওথেলো’, ‘মৃত্যু ও একটি প্রশ্ন’, ‘দক্ষিণের ঘর’, লিস্ট শেষ হওয়ার নয়। থ্রিলারেও তার জাত চিনিয়েছেন ‘লোকার শিকল’ আর ‘দমন’-এ। সিনেমা করেছেন মাত্র দুইটা, তাও কী নিদারুণ! সিনেমা খুব বেশি করেননি, অথচ দুটো ছবিতেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ আর ‘আহা!’ ভাবুন তো, এই মানুষটা যদি আরও সিনেমা করতেন? হয়তো বাংলা সিনেমার খলচরিত্র বা পার্শ্বচরিত্রের এক অনন্য অধ্যায় রচনা হয়ে যেত।
পদকের অভাব, ভালোবাসার নয়
দুঃখের বিষয়, এই প্রতিভাবান মানুষটি বেঁচে থাকতে তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। একুশে পদক? না, সেটাও নয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তার নাম শুনে চেনেন না। ২০১৩ সালে তিনি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। কিন্তু তার কাজগুলো আজও আমাদের চোখে ভাসে। তিনি পেরিয়ে গেছেন সময়ের সীমারেখা। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন হেলাল হয়ে, বিশু পাগলা হয়ে, জাদুকর আনিস হয়ে-আমাদের নাট্য স্মৃতির আকাশে এক উজ্জ্বল তারকা হয়ে। নতুন প্রজন্ম হয়তো তাকে চিনবে না, কিন্তু নব্বই দশকের প্রজন্মেরা এখনো চুপচাপ টিভির সামনে বসে সেই সংলাপটা শুনে- ‘ছি ছি ছি... তুমি এত খারাপ!’ আর একটু হাসি চেপে ফেলে তাকে নিয়ে বলে, ‘আসলে তুমি ছিলে ভয়ংকর ভালো!’