১৯৭২ সালের এইদিনে অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি আমার স্বামী বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নিখোঁজ হন। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। কিন্তু তার অন্তর্ধানের রহস্য আজও উম্মোচন হয়নি। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা আর অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন, বিজয়ের পথ দেখিয়েছেন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে তিনিই নির্মাণ করেন একমাত্র ছবি 'জীবন থেকে নেয়া'। এ ছবিটি বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রেরণা জাগায়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে।
আজকের দিনটি সত্যিই আমার জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্ন বেদনাদায়ক একটি দিন। দিনটি এলেই আমি নির্বাক হয়ে যাই। আজ এত বছর পরে টিভি, পত্র পত্রিকায় তাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু আমি বলব তার অন্তর্ধান এখনো রহস্যে ঘেরা। যা উম্মোচন হয়নি।
অনেকে বলেন, জহির রায়হান তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। আসলে ভাইয়ের সঙ্গে অন্য মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদেরও খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি।
জহির রায়হানকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি সান্ত্বনা দিলেন। আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। পরে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে বনানীতে একটি বাসা দেওয়া হয় আমাকে। পরবর্তীতে বাসাটি নিয়ে নিলে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় নামতে হয় আমাকে। জহির রায়হান ছিলেন সাদাসিধে কাজপাগল মানুষ। মাথা গোঁজার ঠাঁই পর্যন্ত রেখে যেতে পারেননি তিনি। আমার সন্তানরা দুবার জায়গার জন্য রাজউকের কাছে আবেদন করে পায়নি। মৃত্যুর পর মানুষের কবরের জন্য অন্তত সাড়ে তিন হাত জায়গা হয়। জহিরের দুর্ভাগ্য তাও জুটেনি তার জন্য। তার সন্তানদের বাবার কবর দেখারও ভাগ্য হলো না।
দিনটি আসলেই পত্রপত্রিকার কাছে জহিরের কথা বলতে হয়। সারা বছর কেউ খবর রাখে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মকে জানাতে কিছু বলতে হয়। বলতে গিয়ে চারদিকে শুধুই অন্ধকার দেখি। দুচোখ বেয়ে শুধুই হতাশা আর বেদনার অশ্রু ঝরে। জহিরের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন দেশের মাটি ও মানুষকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করবেন তিনি। কেন তার স্বপ্ন অধরা রয়ে গেল?
আমি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। শহীদ পরিবারের সদস্য কিংবা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও আজ পর্যন্ত কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। আমার প্রশ্ন দেশাত্দবোধে উজ্জীবিত একজন মানুষ এবং তার পরিবারকে নিয়ে এমন অবহেলা কেন? তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া কি ভুল ছিল?