১৩ জুন লন্ডন সংলাপের পর বাংলাদেশের নির্বাচনি ট্রেন যেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীরাও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় এ ট্রেনে ইতোমধ্যে উঠে পড়েছেন। গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ট্রেন ছাড়ার। কখন হুইসেল বাজবে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক কথায় যদি বর্ণনা করতে হয়, তাহলে এভাবেই তা করা যায়। পুরো জাতি এখন নির্বাচনের আমেজে। গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায়-মহল্লায়, চায়ের আড্ডায়, অফিসে সর্বত্র নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতারা, প্রার্থী হতে আগ্রহীদের চোখে ঘুম নেই। সবাই তাকিয়ে আছেন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের দিকে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করবে তার অপেক্ষায় গোটা জাতি। ১৭ জুন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটাই চূড়ান্ত সংলাপ। এর মধ্য দিয়ে জুলাই ঘোষণা চূড়ান্ত হবে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ সংলাপ এবং ঐকমত্যের চেষ্টা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বেশি চাপাচাপি করা হয় তাহলে তা তিক্ততা সৃষ্টি করবে। লেবু অতিরিক্ত চিপলে যেমন তেতো হয়ে যায়, কাঁচা কাঁঠাল যেমন কিলিয়ে পাকানো যায় না, তেমন রাজনৈতিক সমঝোতা বা ঐকমত্যও জোর করে চাপানোর বিষয় নয়। আমরা লক্ষ করেছি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ আলাপ-আলোচনায় বেশ কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হয়েছে। এটাই বাংলাদেশের জন্য এক অসাধারণ অর্জন। বিশেষ করে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং টানা দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না-এ রকম মৌলিক বিষয়গুলোয় একমত হওয়াটা একটা বিরাট অর্জন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা একটা ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পেছনে ফেলে এসেছি। গত ১৭ বছর দেশে কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। নির্বাচনব্যবস্থা, সংসদ ইত্যাদি সবই ছিল এক ধরনের সাজানো নাটকের মতো। সে রকম একটি স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থা থেকে হুটহাট সবকিছু চটজলদি যদি ঠিক করে দেওয়ার কথা আমরা বলি, তা হবে অলীক কল্পনা ও অবাস্তব। আমাদের যেতে হবে ধাপে ধাপে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। ন্যূনতম বিষয়ে ঐকমত্য রেখে একটি গণতান্ত্রিক পথে আমাদের অভিযাত্রা শুরু করতে হবে অনতিবিলম্বে। কারণ গণতন্ত্র ছাড়া যে কোনো সংস্কারই অকার্যকর এবং অর্থহীন। একটি জবাবদিহিমূলক সংসদ যদি গঠিত হয়, সেই সংসদের মাধ্যমে বাকি লক্ষ্যগুলো আমরা অর্জন করব। গণতান্ত্রিক চর্চা, অভ্যাস এবং রীতিনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা যেমন একটি সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছিলাম, আবার স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষমতায় আসার পর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। কাজেই কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না, যদি আমরা গণতান্ত্রিক মানসিকতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাগুলো অব্যাহত না রাখি। আমাদের গণতন্ত্র এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবার সহনশীলতা এবং সহযোগিতা দরকার। এ সংস্কার কমিশন গঠন, তাদের সুপারিশ এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাতার সংলাপের মধ্য দিয়ে কয়েকটি বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সবারই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা। আমরা যদি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হই, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করি তাহলে নির্বাচনের বিকল্প নেই।
নির্বাচন নিয়ে একটি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এখানে অত্যন্ত বিচক্ষণতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ সাক্ষাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সব মহলে। কারণ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এক অনিশ্চয়তার পথ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পথে যাত্রা করেছে। এখন দ্রুত সরকারকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসতে হবে। আমরা যদি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যৌথ বিবৃতির মূল মর্ম বুঝে থাকি, তাহলে রোজার আগে নির্বাচন হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হওয়াটা এখন রাজনৈতিক ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত। তাহলে আমাদের হাতে আছে মাত্র সাত মাস। এ সাত মাসে নির্বাচন কমিশনকে অনেক প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি বড় আয়োজনের বিষয়। এজন্য দরকার ব্যাপক প্রস্তুতি।
নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনকে আসন সীমারেখা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। কারণ সীমারেখা বিন্যাসের পর অনেক আপত্তি থাকে, সেটা মীমাংসা করতে হবে। অনেক বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হালনাগাদ ভোটার তালিকা তৈরি এবং তা প্রকাশ করতে হবে। নির্বাচন আচরণবিধি পরিমার্জন-পরিবর্তন করতে হবে। সারা দেশে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। এ নির্বাচন কর্মকর্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ভোট কেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। ব্যালট পেপারসহ নির্বাচনের আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রাক্কলন এবং তার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করতে হবে। এসব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরই নির্বাচন কমিশন একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। সাধারণত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় দুই থেকে তিন মাস সময় সামনে রেখে। অর্থাৎ আগামী চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে অনেক মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য। পাশাপাশি এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোরও বেশ কিছু প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা যখনই হোক না কেন, প্রার্থী চূড়ান্তকরণ, বাছাই এ কাজগুলো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের।
একটি কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং দীর্ঘদিন পর। ১৭ বছর দেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা বিগত তিনটি নির্বাচনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল এবং যে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো হয়েছে তা চিহ্নিত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বব্যাপী সর্বত্রই বলছেন, আগামী নির্বাচন হবে ইতিহাসের সেরা নির্বাচন। ইতিহাসের সেরা নির্বাচন করতে গেলে সেরা প্রস্তুতিও প্রয়োজন। এই সেরা প্রস্তুতি করার জন্য আমাদের হাতে সময় খুব কম রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে আগামী সাত মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এ সেরা নির্বাচন উপহার দিতে হবে। সেজন্য একটা দিন নষ্ট করাও এখন উচিত হবে না। আর তাই ১৭ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিকগুলোর যে সংলাপ হচ্ছে, এটি যেন শেষ সংলাপ হয়। অনেক সংলাপ হলো, অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বিষয়ে তাদের দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। এখন বাকি দূরত্বগুলো কমিয়ে আনতে হবে জাতীয় সংসদে। জাতীয় সংসদ যদি সত্যিকার অর্থে জবাবদিহিমূলক এবং আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রভূমি হয় তাহলে সংসদই হবে আসল সংলাপের জায়গা।
নির্বাচনের সময়সূচি জুলাই গণহত্যার বিচারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনের সময় যত অনিশ্চিত থাকবে, তত বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। কারণ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ দৃঢ় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় না, পারেও না। আমরা জানি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। কিন্তু যখনই নির্বাচনের ট্রেনের সময়সূচি ঘোষণা করা হবে এবং ট্রেন তার গন্তব্য থেকে যাত্রা করবে, তখন এ অনিশ্চয়তা আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকবে। সবাই জানবে কতদিন পর জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। একটি নির্বাচিত সরকার আসছে। কাজেই সবাই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহনশীলতার পরিচয় দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে যে হুলুস্থুল আন্দোলনগুলো হচ্ছে, যেটা ঈদের পর আবার নতুন করে শুরু হয়েছে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে নির্বাচনের অপেক্ষায়। দেশ অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে এক উৎসবের জগতে প্রবেশ করবে। এ নির্বাচনি উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা চূড়ান্তভাবে স্বৈরাচারের কবর রচনা করব এবং নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বিনির্মাণ শুরু করতে পারব। নতুন সরকার জাতির সামনে যেসব অঙ্গীকার করেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে সেগুলো প্রতিপালন করবে এবং একটি সুশাসনের পথে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাবে। কাজেই একটি নির্বাচনি ট্রেনের সময়সূচি ঘোষণা করা এবং হুইসেল বাজানোটা এখন সরকারের প্রধান কাজ।