ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের মতো এখনকার গানের কথা ও সুর দর্শকহৃদয়ে সাড়া জাগাতে পারছে না। তখনকার গানগুলো এখনো গুনগুন করে গায় শ্রোতারা। রোমান্টিক, আধ্যাত্দিক কিংবা দুঃখের- যাই হোক না কেন সেসব গানের কথা মনে পড়লে আজও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয় শ্রোতাকুল। বর্তমানে ভালো গান হচ্ছে না তাও কিন্তু নয়। তবে এসব গান সেকালের গানের মতো শ্রোতাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে না। শোনার পরপরই আর মনে থাকে না গানের সুর ও কথা। মানে এখনকার গান হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী। এই অভিযোগ শ্রোতাদের। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত গীতিকার কে জি মোস্তফা বলেন, গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাব্যময়তা ও মেলোডি। এখন তা কোথায়? আগে তো গান লিখতে রীতিমতো পড়ালেখা করতে হতো। বিষয়টি যেন একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এ ক্ষেত্রে এখন সাহিত্যনির্ভরতাকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে যা হওয়ার স্বাভাবিক তাই হচ্ছে। আগের গানে জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেত। এখন তো গান মানে ফান। তাই শুরুতেই শেষ হয়ে যায় এসব গান। এখন গানের ক্ষেত্রে যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার করতে হবে, লাফালাফি করতে হবে, না হলে গান হবে না। এক কথায় এখনকার গানে মেলোডি, কাব্যময়তা, জীবনবোধ, শিক্ষা এবং গভীরতা বলতে কিছুই নেই। গান লেখা এবং করা বর্তমানে এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে, সহজে হারিয়েও যাচ্ছে'।
বিশিষ্ট গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর কথায়- 'এখন তো সবকিছুই আধুনিক হয়ে গেছে। গানের মধ্যেও এই ছায়া পড়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গানেও পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন মানে মন্দ কিছু নয়। কিন্তু এই পরিবর্তন যেন মনের মধ্যে মন্দ প্রভাব না ফেলে। কারণ গান হচ্ছে মনের খোরাক। এ বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া হচ্ছে না বলেই গান আগের মতো স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। এ ছাড়া গানের স্থায়িত্ব হ্রাসের আরও কারণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিনদেশি সংস্কৃতির অনুকরণ, গানকে সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য করে তোলা, গানের কথায় জীবনবোধের অভাব, সুরের চেয়ে যন্ত্রের আধিক্য, দ্রুত উচ্চালয়ে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে সব শ্রেণির মানুষের মনের মতো করে যেন গান তৈরি করা হয়। তাহলে গান সহজবোধ্য হবে এবং স্থায়িত্ব পাবে।'
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও গীতিকার আমজাদ হোসেন বলেন, 'বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাই এখনকার গান আর শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব। গানের কথা ও সুরে এখন মেলোডি এবং জীবনবোধের অভাব, গভীরতা নেই। সানাই, সেতার, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়ামসহ কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ব্যবহার করা হয় না। এখন সবই কি-বোর্ড নির্ভর হয়ে পড়েছে। চাইলেই যে কেউ করতে পারছে। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান আর থাকে না। এখন চলচ্চিত্রের গানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে'। বিশিষ্ট গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, 'সংগীত হচ্ছে আত্মার খোরাক। মানুষের ভিতর যত দিন আত্মা ও হৃদয় থাকবে তত দিন সংগীত থাকবে। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না। আত্দিক শক্তিতে বলীয়ান হয় না- সেই গান অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী। অমরত্বের জন্য গানকে হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে রচনা করতে হবে। কারণ সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। গান এক সময় ছিল জীবনমুখী ও নৈতিকতাপূর্ণ। গল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, মাখামাখি পূর্ণ। সেই গান মানুষের হৃদয়কে দোলা দিত, তাড়িত করত। সেই অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে গানকে আবারও জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে'।
প্রখ্যাত শিল্পী খুরশীদ আলম বলেন, গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেয় না। সাধনাও করে না। তাই সব গান প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাসও সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। আর এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসাতেই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। এ অবস্থার উত্তরণে ওই যে বললাম গুরুর দীক্ষা আর সাধনা জরুরি।