নীহার বানু হত্যাকাণ্ড মামলায় তিনি আলোচিত আইনজীবী। যে ঘটনা রাজশাহীকে ছাড়িয়ে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছিল। তাকে তখন চিনেছিলাম সংবাদ, ইত্তেফাকসহ হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকার সুবাদে।
ছাত্র রাজনীতির সুবাদে তাকে জানতে সুবিধা হয়েছিল। তিনি তুখোড় ছাত্র রাজনীতিক ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পর গড়ে উঠা ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৭ এর ন্যাপ। কামগামীর পর ওয়ালী ন্যাপ। দেশ স্বাধীনের ন্যাপ মোজাফফর ন্যাপের বিভক্ত হলে তিনি চৌধুরী হারুনের ন্যাপে যুক্ত থাকেন। তিনি রাজশাহীতে গড়ে উঠা প্রতিটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
১৯৯১ সালে সাম্প্রদায়িক শক্তির দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় আমাসি হয়ে আমি, রাগীব আহসান মুন্না (রাকসু ভিপি) জিয়াউল হাসান (Ziaul Ahsan প্রো-ভিপি), শাহীন (ভিপি শের-ই- বাংলা হল, শাহরিয়ার মিতু (ভিপি নবাব আব্দুল লতিফ হল), শহরের রায়হান ভাই ও মুহিত ভাই সিনেট সদস্য, হিটলার ভাইসহ ১৪ জন ছাত্রনেতা আসামি। মামলার ট্রায়াল শুরু হবে। আমরা ঢাকা থেকে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে আমাদের মামলায় আনতে চাইলাম। আমাদের জন্য Fazle Hossain Badsha ভাই প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন তাদের। পরে তারা (ড. কামাল হোসেন) পরামর্শ করে ঠিক করে দেন প্রবাদ প্রতীম আইনজীবী এডভোকেট সিরাজুল হককে।
আমরা হতচকিত হয়ে যাই। কারণ তখন তিনি এরশাদের অস্ত্র মামলায় আইনজীবী। আর আমরা সবে এরশাদকে কান ধরে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছি। আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলাম। পরে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম স্যার আমাদের বললেন, আমি বা কামাল হোসেন সাহেব গেলে যদি ভালো হতো তাহলে আমরাই যেতাম। যিনি এ বিষয়ে পারদর্শী এবং বেস্ট হবেন তাকেই আমরা সিলেক্ট করেছি। যে সত্যতা পরে আমরা পেয়েছি। আমরা আত্মসমর্পণ থেকে ট্রায়ালের শেষ পর্যন্ত গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্ব রাজশাহীর চারজন আইনজীবীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছি যারা হলেন প্রয়াত আইনজীবী জুনিয়র আশরাফ (রাজশাহী বারে বাদশাহ ভায়ের বাবা সিনিয়র আশরাফ নামে পরিচিত ছিলেন), শেলী ভাই এবং জাসদের এটভোকেট মাসুম আহমেদ টিপু ভাই।
আমি আইনজীবী সনদের জন্য রাজশাহী বার থেকে গোলাম আরিফ টিপুর মাধ্যমে ইন্টিমেশন দিয়েছিলাম। যা হোক ঢাকায় বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী সিরাজুল হক বললেন, আমরা যেনো গোলাম আরিফ টিপুকে দিয়ে ব্রিফগুলো গুছিয়ে নেই এবং তিনি যেনো সামগ্রিক প্রস্তুতি নেন। আমরা তার সাথে দেখা করি। তিনি বললেন, তিনি আমাদের সেশন কোর্টে হাজির করিয়ে দেবেন।
জানালেন তিনি সবকিছুই করবেন কিন্তু ট্রায়ালে সরাসরি থাকবেন না। আমরা ভাবলাম এটি ইগো কনফ্লিক্ট কিনা! ভীষণ চিন্তা। এগুলো দোলাচালে ফাঁসির দঁড়িতে প্রাণ যায় কিনা। কারণ তখনো বুঝতাম না কোনটা প্রজ্ঞা ও মহানুভবতা আর কোনটা কনফ্লিক্ট। তিনি আমাদের দায়রা আদালতে স্যারেন্ডার করে দেন। সেখানে আমাদের জামিন শুনানি হয়নি। নথি পাঠিয়ে দেয়া হয় সদ্য গঠিত সিটি ম্যাজিস্ট্রেট বিষ্ণু পদ সাহার কোর্টে। এর অনেক পরে ঈদের আগের দিন জামিনে মুক্ত হই। সে শুনানিতেও তিনি ছিলেন।
মামলার ট্রায়াল জেলা ও দায়রা জজ প্রয়াত দাউদ সাহেবের আদালতে হওয়ার কথা। আমাদের মামলাটি বহুল আলোচিত ও স্পর্শকাতরতার নামে বিভাগীয় স্পেশাল জজ মজিবর রহমান প্রধান এর আদালতে তিনি বদলি করে দেন। যেখানে আমাদের পক্ষে জুনিয়র আশরাফ প্রথম দিকে এবং শেষ দিকে সিরাজুল হক স্যার জেরা পর্বে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজুল হক স্যার যুক্তিতর্কও করেন। সেসব বিষয় পরে উত্থাপন করা যাবে।
এই পর্বগুলোতে আমার নিকট থেকে সিরাজুল হক স্যার এবং গোলাম আরিফ টিপু স্যারকে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেছি।
ট্রায়াল পর্বে সিরাজুল হক স্যার আমাকে বলেছিলেন গোলাম আরিফ টিপুর মতন আইনজীবীর জন্ম হয় কালেভদ্রে। তার প্রজ্ঞার তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন।
আমরা সাধারণত দেখি কনটেম্পোরারিদের পরস্পরের প্রতি কিছুটা দূরত্ব। সিরাজুল হক স্যারের তার প্রতি শ্রদ্ধা আমাকে অভিভূত করেছিল।
বিচারের এক পর্যায়ে মজিবর রহমান প্রধান মামলাটির বিচার তিনি করতে চাননি বলে নানা কারণ দেখিয়ে মামলা বদলির জন্য তিনি হাইকোর্টে আবেদন করেন। সেখানে কিছুটা কালক্ষেপণ হয়। পরে তিনি বদলি হয়ে গেলে বিচারক হয়ে আসেন আব্দুল হাই (পরে বিচারপতি)। তিনি মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষীসহ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুনেন।
মামলাটির রায় প্রকাশিত হয় ২৭ জুলাই ১৯৯২। রায়ের কয়েকদিন আগে থেকে জজ সাহেব নিরুদ্দেশ। কোথায় আছেন পিয়ন-পেশকার কেউ বলতে পারেননি। এদিকে শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবল উত্তেজনা। শহরের মোড়ে মোড়ে রায়ের দিন কয়েক আগ থেকেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও বাড়তি টহল। এগুলো আমাদের মনে অজানা শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেয়। কয়েক মাস আগে আমাদের মামলার জন্য রাজপথে জীবন দিয়েছেন জাসদ ছাত্রলীগের ইয়াসির আরাফাত পিটু। অন্যদিকে শিবির প্রধান এলাকাগুলোতে আমাদের ফাঁসির দাবিতে মৌলবাদীদের মিছিল মিটিং একটা অন্ধকার গহব্বরের ইঙ্গিত করছিল।
২৭ জুলাই মামলার রায়। সমগ্র রাজশাহী শহর পুলিশ-বিডিআর দিয়ে জ্যাম। কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী। যে নিরাপত্তা বেষ্টনী আদালত ও হরগ্রাম এলাকায় শহরের চেয়ে বহুগুণ। এরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা সে সময় রাজশাহীবাসীর জন্য নতুন। যা হোক আমরা ক্যাম্পাস থেকে হাজার ছাত্র এবং শহরের পথে পথে হাজারো মানুষ আমাদের সেদিন শুভাশিস ও আদালতে ঢোকার আগে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় দেয়। মামলায় আমরা কয়েকজন উপস্থিত হলেও অনেকে অজানা আশঙ্কায় অনুপস্থিত! আমরা আদালত চত্বরে ঢুকতেই কয়েকজন জানালেন এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু আমাদের জন্য আইনজীবী সমিতির দ্বিতল গ্রন্থাগারে অপেক্ষা করছেন। আমি এবং মুন্না ভাই ভেতরে যেতেই বললেন একটা পিটিশন ড্রাফট করেছি একটু পদ পদবীগুলো ঠিক করে দাও।
পিটিশন পড়ে সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। পিটিশনটা কিছু নয় জেলখানায় আমাদের জন্য ডিভিশনের আবেদন। যেখানে জেল হলে ডিভিশন পাওয়ার জন্য বলা আছে। মুন্না ভাই সাবেক ভিপি রাকসু, আমি সাবেক এজিএস ও বর্তমান সিনেট সদস্য। অন্যদের পদবীও তুলে ধরা হয়। আমায় টিপু স্যার বললেন, আব্রাহাম লিংকন ঠিক থাকলে বলে যাও। আদালত বসে যাবে।
মনে হলো ফাঁসিকাষ্ঠে দঁড়িতে ঝুলবার আগে আমাদের শেষ বিধি ব্যবস্থা জানিয়ে দেয়া। কিছু না হোক জেলে যাতে থাকা খাওয়া কদিন ভালো পাই।
যা হোক আমরা মামলাটি থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছিলাম। আদালত বলেছিলেন - আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোনোভাবেই মামলাটি প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা সেদিন সন্দেহের সুবিধায় খালাস পাইনি। আমাদের বিরুদ্ধে এজাহারের সাথে ঘটনা ও প্রদত্ত সাক্ষের কোন মিল ছিল না।
খালাস হওয়ার পর আমি গোলাম আরিফ টিপু স্যারের উপ-শহরের বাসায় গিয়েছিলাম সালাম ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। তাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনি কেন এই মামলায় বিচার পর্বে অংশগ্রহণ করেননি।
তিনি বলেছিলেন, জজ সাহেব আমাকে কমফোর্ট ফিল করেন না। আমি চাইনি আমার কারণে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হও। আমার কাছে নিজের নাম ফোটোনোটা কাজ নয়, তোমাদের জীবন রক্ষা করাটা জরুরি। আমাদের দেশে অনেক হাকিম উকিলের ওপরে করা রাগ মক্কেলের ওপর চাপায়। ফলে খালাসের মামলায় জেল, আর জেলের মামলায় খালাস পায় মক্কেল।
তখন ১৯৯২ সাক আমি নবীন আইনজীবী। ওই কঠিন কথাগুলো বুঝবার মতন জ্ঞান আমার হয়নি। নিজের পেশাগত জীবনে আজ তার কথাগুলোর মর্মার্থ অনুভব করি। কত জ্ঞান আর মহানুভবতা থাকলে সেটি সম্ভব।
আজকে আপনার নব্বই বছরে পদার্পণের দিনে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। চাই নিরোগ জীবন ও সুস্থভাবে শতাব্দী অতিক্রম।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        