বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিশু-কিশোরদের মাঝে আমি লাখো রাসেল খুঁজে পাই

শেখ হাসিনা

শিশু-কিশোরদের মাঝে আমি লাখো রাসেল খুঁজে পাই

আমাদের বাসায় আমাদের পরিবারের সব থেকে ছোট রাসেল, রাসেলের জন্ম হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ঠিক যে মুহূর্তে রাসেলের জন্ম হয়, সে সময় আব্বা খুব ব্যস্ত ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে। ফাতেমা জিন্নাহ প্রার্থী। সে নির্বাচনের প্রচারণার কাজে তিনি চট্টগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন। রাসেলের জন্ম হওয়ার পর আমরা তাঁকে খবর দিই। আমি, কামাল, জামাল এবং রেহানা আমরা চার ভাই-বোন উদ্বিগ্ন হয়ে বসেছিলাম, এই ছোট্ট শিশুটির জন্ম মুহূর্তটার জন্য। তারপর তাকে কোলে নেওয়া, লালন-পালন করা, তার পাশে থাকা। ’৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাসেলের জন্ম।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণা করলেন। যে ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ’৬৬ সালের মে মাসে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। ছোট্ট রাসেলের তখনো দুই বছর পূর্ণ হয়নি, তার আগেই পিতার স্নেহবঞ্চিত। আমরা কারাগারে যেতাম আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। রাসেল কিছুতেই আসতে চাইত না, সে বাবাকে ছাড়া আসবে না, বাবাকে নিয়েই ঘরে ফিরবে। সে সময় আমার বাবা বলতে বাধ্য হলেন যে, এটা আমার বাড়ি আমি থাকি, তুমি তোমাদের বাড়িতে যাও, মায়ের বাড়িতে যাও। তখনো সে ভালো করে কথাও বলতে পারে না, তারপরও সে প্রচ  কান্নাকাটি করত। তখন অনেক ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে আমাদের নিয়ে আসতে হতো। যেদিন আমরা জেলখানায় দেখা করতে যেতাম, সেদিন সে খুব অস্থির থাকত, ভালো করে ঘুমাতে চাইত না, খেতে চাইত না। অনেক সময় মধ্যরাতে উঠে বসত, আমাদের সবাইকে ডাকত। আমরা সব ভাই-বোন উঠে তার কাছে যেয়ে বসতাম, সে কিছু বলতে পারছে না, সে তার মনের ভাবটা জানাতে পারছে না, কিন্তু তার সেই অব্যক্ত ব্যথা-বেদনা- আমরা বুঝতে পারতাম।

এভাবেই সে বড় হয়ে উঠে, বাবাকে বাবা বলে ডাকাও শুরু করে। অনেক সময় আমার মা, যখন ও আব্বা বলে ডাকত তখন বলতেন যে, আমিই তোমার আব্বা, আমাকেই ডাকো। কারাগারে যেয়ে একবার সে বাবার মুখের দিকে তাকাত ও মায়ের মুখের দিকে তাকাত এবং আব্বা বলে ডাকত। তখন মা বলেছিলেন যে, ও যেহেতু আব্বা আব্বা করে কান্নাকাটি করে, তো আমি বলেছি আমাকেই আব্বা ডাকো। সেজন্যই সে জেলখানায় যেয়ে একবার বাবার দিকে তাকায় এবং একবার মায়ের দিকে তাকায়।

 একটা ছোট্ট শিশু পিতার ¯ন্ডেœহবঞ্চিত, আমরা তো বঞ্চিত ছিলামই। এরপর যখন ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ, দেশের জনতা, আমাদের সংগঠনের সবাই মিলে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্ত করে নিয়ে আসল, তখন রাসেল বাবাকে বাড়িতে পেল। একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করতাম যে, সে খেলার ছলে ছলে কিছুক্ষণ পরপর আব্বা কোথায় আছেন, দেখতে আসত।

আমাদের ৩২ নম্বরের ছোট বাড়ির যে লাইব্রেরি ঘরটা আছে ওখানেই আব্বা বসতেন, পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলতেন ও তখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া এবং অনেক কাজ করতেন। কিছুক্ষণ পরপরই রাসেল ছুটে ছুটে আসত আব্বাকে দেখার জন্য। মনে হতো যেন ওর ভিতরে তখন একটা ভয়, বাবাকে হারাবার একটা ভয়। সে ভয়টাই যেন মাঝে মাঝে ওর ভিতরে দেখা দিত।

এরপর আমাদের ’৭০-এ নির্বাচন হলো। পাকিস্তানি শাসকরা, সামরিক শাসকরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিল না, মুক্তিযুদ্ধ হলো। যখনই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন ২৬-এ মার্চ প্রথম প্রহরে, তখনই তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। আবার রাসেল পিতৃ ¯ন্ডেœহবঞ্চিত। এরই একটি পর্যায়ে আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হলো। ১৮ নম্বর ধানমন্ডির একটা বাড়িতে নিয়ে রাখা হলো। রাসেল খুব চাপা স্বভাবের ছিল, সহসা নিজে কিছু বলত না। তার চোখে সবসময় পানি, যদি বলতাম তোমার চোখে পানি কেন? বলত চোখে যেন কী পড়েছে।

ওইটুকু ছোট বাচ্চা সে তার নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখত! আমার ভাবতে অবাক লাগে। কারণ আমার ছোট ভাই কামাল মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। জামাল বন্দীখানা থেকে গেরিলা কায়দায় বের হয়ে সেও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু এই রাসেল এবং আমরা সেখানে আমার মার সঙ্গে। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম, আমার কোলে জয় এলো। সেই যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হতো বিশেষ করে যখন এয়ার রেইড হতো, রাসেল পকেটে সব সময় একটু তুলা রাখত এবং নিজের কান থেকে ছোট্ট জয়ের কানে দিয়ে দিত যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনো ক্ষতি না হয়। কারণ আমাদের ওই একতলা বাসা, সেখানে মেশিনগান ফিট করা ছিল- অনবরত গোলাগুলি হতো। জয়কে বিছানায় শুয়ে রাখা যেত না, অত্যন্ত ছোট বাচ্চা সব সময় কোলে রাখতে হতো। কিন্তু রাসেল খুব খেয়াল রাখত জয়ের প্রতি। সব সময় তার দিকে বিশেষ নজর সে দিত।

স্বাধীনতার পর, বিজয়ের পর আব্বা যখন ফিরে এলেন, আপনারা দেখবেন অনেক ছবিতে রাসেলকে সব সময় তার পাশে। রাসেল যেন কোনোমতেই বাবাকে ছাড়তে চাইত না। যেখানেই যেত সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে যেতে চাইত।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট, একই সঙ্গে এই বাড়িতে একটি প্রাণীও বেঁচে থাকতে পারেনি। কিন্তু আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা তখন জার্মানিতে ছিলাম। জার্মানিতে যখন ছিলাম, তখন একটা খবর পেয়েছিলাম যে হয়তো রাসেল বেঁচে আছে, কিন্তু না রাসেল বেঁচে নেই। ছোট্ট শিশুদের যেমন একটা স্বপ্ন থাকে জীবনে সে কী হবে- রাসেলের খুব শখ ছিল সে বড় হলে আর্মি অফিসার হবে, সে আর্মি হবে এবং সেই সময় সেভাবে সে কিন্তু নিজেকেও তৈরি করত। আর ছোট ছোট গরিব শিশুদের প্রতি তার প্রচ  দরদ ছিল। যখন ও গ্রামে যেত গ্রামের অনেক শিশুকে সে জোগাড় করত। সে যা চাইত আমরা চেষ্টা করতাম তাকে সব দিতে। সে কাঠের বন্দুক বানাত এবং এই শিশুদের জন্য মাকে বলত যে, ওদের কাপড়-চোপড় কিনে দিতে হবে এবং মা ঠিকই তাদের জন্য কাপড়-চোপড় কিনে দিতেন। ওদেরকে নিয়ে সে প্যারেড করাত। আবার প্যারেড করানো শেষে তাদের খাবার-দাবার দিত। আর ছোট ছোট এক টাকার নোটের বান্ডিল থেকে সবাইকে একটা করে টাকাও দিত সে এবং যখনই যেত এটা সে করবেই।

১৫ আগস্টের পর ছয় বছর তো আমরা দেশে আসতে পারিনি। ছয় বছর পর যখন দেশে আসি, যখন টুঙ্গিপাড়া যাই, সেখানে একটা আলমারি ছিল; সে আলমারির ভিতরে দেখি অনেকগুলো ছোট ছোট শিশুদের জামা তখন পড়ে আছে। কারণ জানতাম যে, এগুলো রাসেল ওই গ্রামের গরিব শিশুদের মাঝে সব সময় বিতরণ করত এবং তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিত, সেগুলো তখনো পড়েছিল। কারণ ও যেহেতু যতবারই বাড়ি যেত তখনই দিত, মা সব সময় বেশি করে কিনে রেখে দিতেন। তার ভিতরে এই যে একটা দরদি মন ছিল, হয়তো সে বেঁচে থাকলে এ দেশের জন্য অনেক কিছুই করতে পারত। আজকে মাঝে মাঝে মনে হয়, রাসেল বেঁচে থাকলে এখন ৫৪ বছর বয়স পূর্ণ করত। এই ৫৪ বছর বয়সে রাসেল কেমন হতো দেখতে?

আমি তার বড় বোন, আমি কোলে-পিঠে করেই তাকে আসলে মানুষ করেছি সব সময়। আমাদের অতি আদরের ছিল সে। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকে বাঁচতে দিল না। সব থেকে বড় কথা হলো, এই যে হত্যাকা  হলো আমাদের বাসায় যেমন, সেই সঙ্গে আমার মেজো ফুফুর বাড়ি, সেখানে আমার মেজো ফুফুর ছেলে শেখ ফজলুল হক মণি এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করা হলো। আমার সেজো ফুফুর বাড়িতে আক্রমণ করল। রাসেলেরই খেলার সাথী আমার ফুফাত ভাই আরিফকে হত্যা করল, ১৩ বছরের মেয়ে বেবিকে হত্যা করল এবং ৪ বছরের আমার ফুফাত ভাইয়ের ছেলে সুকান্তকে হত্যা করল। এভাবে ওই পরিবারের আমাদের অনেক সদস্যকে হত্যা করল, সব মিলে প্রায় ১৮ জন সদস্য। শুধু এখানেই না, তাদের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে প্রায় ১১ জনের মতো নিহত হয়।

এই যে এত বড় একটা হত্যাকা  হলো, এই হত্যাকান্ডে র কিন্তু বিচার হবে না বলে একটা আইন পাস করানো হয়েছিল। এই যে আজকে একটা জিনিস আপনারা দেখতে পারেন যে, যারা শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকেই হত্যা করেনি, শিশু হত্যা করেছে, নারী হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে না। আইন করে এই খুনিদের বিচারের হাত থেকে মুক্ত করে, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এর প্রভাবটা সমাজে কীভাবে পড়ে। এত বড় একটা অপরাধ যারা করেছে তাদের বিচার করা যাবে না।

’৮১ সালে আমি বাংলাদেশে ফিরে এসে চেষ্টা করেছিলাম মামলা করার। আমাকে বলা হলো যে, এই হত্যার মামলা করা যাবে না। অর্থাৎ আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার পাব না, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার পাব না, আমার বাবার হত্যার বিচার পাব না। আমার প্রশ্ন ছিল, আমি কি এ দেশের নাগরিক নই, সবাই যদি বিচার চাইতে পারে তো আমি বিচার চাইতে পারব না কেন? আমরা ১৫ আগস্টে যারা আপনজন হারিয়েছিলাম আমাদেরকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, আর খুনিদের করা হয়েছিল উৎসাহিত, পুরস্কৃত।

এর প্রভাবটা যে আমাদের সমাজে পড়ে। আজকে একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমরা কিছুদিন ধরে দেখছি যে, শিশুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার। এই যে সমাজে এই ধরনের একটা ঘটনা ঘটছে, সে সময় যদি ওই শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারীদের বিচার করা হতো, তাহলে অন্তত মানুষের ভিতরে একটা ভয় থাকত। এই ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠত না। কিন্তু এরপর থেকে আমাদের সমাজে দেখেছি এবং কী আশ্চর্যের ব্যাপার, কী অ™ভুত ব্যাপার যে, বাবা হয়ে সন্তানকে হত্যা করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য। কী বিকৃত মানসিকতা এ দেশের মানুষের মনে। আসলে ১৫ আগস্টের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা দেশের কথা, মানুষের কথা, জাতির কথা কখনো ভাবেনি। তারা শুধু ভেবেছিল তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখা, ধনসম্পদ বানানো, অর্থশালী, বিত্তশালী হওয়া, নিজেদের জীবনটাকে অন্তত সেইভাবে আর্থিকভাবে সচ্ছল করে গড়ে তোলা- এসব নিয়ে। এ দেশের যারা বঞ্চিত মানুষ তাদের দিকে তাদের কোনো লক্ষ্য নেই। 

কিন্তু স্বাধীনতার পর জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে শিশু আইন করে যান, শিশু অধিকার আইন। স্বাভাবিকভাবে ২১ বছর পর যখন সরকার গঠন করি তখন আমরা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নীতিমালা, আইন করা, শিক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং তাদের গড়ে ওঠা, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা সব ব্যবস্থাই কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে করেছি। আমাদের শিশুদের ভিতরে যে মেধা, যে মনন, যে শক্তি তা যেন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।

স্বাভাবিকভাবে আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য, আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠা আমাদের শিশুরা যেন শিক্ষা নিতে পারে তার জন্য কম্পিউটার শিক্ষা থেকে শুরু করে এ ধরনের প্রযুক্তির শিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষার ওপরও আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ আমরা চাই আমাদের আর কোনো শিশু যেন এ ধরনের হত্যার সম্মুখীন কখনো না হয়, প্রত্যেকটা শিশু যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, আর প্রত্যেকটা শিশুর জীবন যেন অর্থবহ হয় সেটাই একমাত্র আমাদের লক্ষ্য। এ ধরনের অন্যায়, অবিচার এটা কখনো বরদাস্ত করা হবে না। কাজেই আজকে যারা এ ধরনের শিশু নির্যাতন বা শিশু হত্যা করবে তাদের কঠোর থেকে কঠোর সাজা পেতে হবে, অবশ্যই পেতে হবে।

আমাদের শিশুরা যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ না করে সে ধরনের ব্যবস্থাও নিয়েছি এবং তাদের শিক্ষাদিক্ষা দিয়ে এমনকি যারা হয়তো লেখাপড়া বা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়নি সেই ঝরে পড়া শিশু, তাদেরও শিক্ষা, কর্মক্ষম এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। আর যারা একেবারে এতিম বা যাদের দেখার কেউ নেই তাদের জন্যও আমরা কিন্তু বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।

যারা প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধী যারা হয়েছে বা অটিজমে যারা ভুগছে এ শিশুদের তো কোনো দোষ নেই। এই যে আমি আজকে যারা শিশু এখানে আছে তাদের একটা কথাই বলব, তোমরা যারা ছোট এখনো, তোমাদের আশপাশে যখন দেখবা কেউ প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক অথবা দরিদ্র তাদের কখনো অবহেলা কোরো না। তাদের আপন করে নিও, তাদের পাশে থেকো, তাদের সহযোগিতা কোরো। কারণ তারাও তো তোমাদের মতনই একজন। কখনো কোনোভাবেই যেন তারা অবহেলার শিকার না হয়। কারণ আমরা ছোটবেলা থেকে পড়েছি কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না। আসলে এটা বলা নিষ্ঠুরতা, এটা বলা অমানবিকতা। আমাদের শিশুরা নিশ্চয়ই তা করবে না।

খেলাধূলা, প্রতিযোগিতার ব্যাপক ব্যবস্থা আমরা করেছি। আমরা ১৯৮৯ সালে শিশুদের নিয়ে শিশু সংগঠন হিসেবে ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ’ প্রতিষ্ঠানটা গড়ে তুলেছিলাম শিশুদের পাশে থাকার জন্য। আর সেই প্রতিষ্ঠানটা আজকে অনেক বড় হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক ছেলেমেয়ে আজকে কত বড় হয়ে গেছে। তারা অনেকেই জীবনের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আজকে রনি ওখানে ঘোষণা দিচ্ছে- সে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছে। ঠিক এরকম আমাদের শিশু-কিশোর পরিষদের অনেক ছেলেমেয়ে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় তারা তাদের স্থান করে নিতে পেরেছে। আর একটি বিষয়, সংগঠন করার মধ্যদিয়ে দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, অধিকার বোধ- এটাও কিন্তু থাকতে হবে। কারণ এ দেশটা আমাদের, এ দেশটাকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মর্যাদাপূর্ণ একটি জাতি হিসেবে আমাদের গড়ে উঠতে হবে।

আমরা সরকারে আসার পর থেকে যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি, সেখানে আজকের যারা শিশু বা এই মুহূর্তে যে শিশুটিও জন্ম নেবে তার ভবিষ্যৎটাও যেন সুন্দর হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কিন্তু আমরা অনেক পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই প্রণয়ন করেছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী আমরা উদ্যাপন করব ২০২০ সাল থেকে। ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করব। তাই ২০২০-২১ আমরা ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি।

আমরা চাই আমাদের প্রতিটি শিশু লেখাপড়া শিখবে, উন্নত জীবন পাবে, সুন্দর জীবন পাবে। আজকে এখানে প্রতিযোগিতায় যে শিশুরা পুরস্কার পেয়েছে তাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন। যাদের আমি হাতে তুলে দিতে পেরেছি বা যাদের দিতে পারিনি সবাইকে আমি আমার অভিনন্দন জানাই। আমি চাইব যে, খেলাধূলা, সংস্কৃতি চর্চা সবক্ষেত্রে আমাদের শিশুরা অংশগ্রহণ করবে। আর সমাজের যে খারাপ দিকটা সেদিক থেকে তারা দূরে থাকবে। যেমন মাদককে আমরা যেন ‘না’ বলি। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদকের থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সততার সঙ্গে জীবনযাপন করা। কারও বড় একটা গাড়ি আছে দেখে আমারও লাগবে, কারও একটা সুন্দর বেশি দামি কাপড় আছে দেখে আমারও লাগবে- এ চিন্তাটা যেন কখনো মনে না আসে। নিজেকে কখনো ছোট মনে করবে না- এটা আমার একটা অনুরোধ থাকবে।

আমি মনে করি, সব শিশুর ভিতরে একটা সুপ্ত চেতনা রয়েছে, মনন রয়েছে, শক্তি রয়েছে এবং সেটা বিকশিত করতে হবে। তুমি নিজেকে কতটুকু পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পার, লেখাপড়া, খেলাধূলা বা সংস্কৃতি চর্চায় সবকিছুতে কতটা নিজেকে গড়ে তুলতে পার, নিজেকে বিকশিত করতে পার, কতটা তুমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পার- সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় অলঙ্কার, সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় শক্তি। আর সততার সঙ্গে জীবনযাপন করলে সবসময় নিজের ভিতরে এমনিতেই একটা কিন্তু শক্তি সঞ্চার হয়। কারণ কারও কাছে কখনো মাথা নত করে চলতে হয় না।

আমি চাই আমাদের এ সংগঠনের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে এ কথাটাই মনে রেখে নিজেকে তৈরি করবে যে, শুধু আমি নিজে পাব, নিজে খাব, নিজে পরব- সেটা নয়। কতটুকু আমার আশপাশের শিশুদের দিতে পারি, কতটুকু তাদের জন্য করতে পারি, কতটুকু তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। দরকার হলে নিজের খাবার ভাগ করে খাব। কারণ এটা কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করতেন। তিনি একটা দরিদ্র মানুষ দেখলে বা দরিদ্র শিশু হলে নিজের খাবারও ভাগ করে খেতেন, বই-খাতা দিয়ে দিতেন, কাপড়-চোপড় দিয়ে দিতেন। তিনি কিন্তু সব সময় করতেন এবং আমার দাদি কোনোদিন এ ব্যাপারে কখনো নিষেধ করেননি।

ঠিক সেই গুণটি রাসেলের মধ্যেও ছিল। কারণ গ্রামে গেলেই ওই দরিদ্র শিশুদের কিছু দিতে হবে এটা সে সব সময় চিন্তা করত। কাজেই আমি এটা চাই যে, রাসেল নামের সংগঠনের সব শিশু তাদের মধ্যে এই চিন্তাটা থাকতে হবে। সেই ’৮৯ সালে গড়ে ওঠা সংগঠনের তখনকার শিশুরা আজকে বড় হয়েছে, সমাজের বিভিন্ন জায়গায় তারা আছে। তারা তাদের দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতার প্রমাণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে এই শিক্ষাটাও তাদের নিতে হবে যে, তাদেরও এই সমাজের জন্য কিছু করার আছে বা অন্য দরিদ্র্য শিশু- তাদের জন্য কিছু করার আছে। ইনশাআল্লাহ, বাংলাদেশ আর দরিদ্র থাকবে না। বাংলাদেশের সব মানুষই উন্নত জীবন পাবে, সুন্দর জীবন পাবে।

আমরা যেমন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছি, আমরা পুষ্টির নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি, মাতৃমৃত্যু হার কমিয়েছি, শিশুমৃত্যু হার কমিয়েছি এবং সমাজকে আমরা সুন্দরভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি এবং আমাদের এ পরিকল্পনা একেবারে শত বছর পর্যন্ত।

আজকের শিশুরা হয়তো ’৪১ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে, সেই দেশের কর্ণধার হবে। আবার ২০৭১ সালে আমরা আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ উদ্যাপন করব। কাজেই, আগামী দিনের প্রজন্ম অর্থাৎ প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন একটা সুন্দর জীবন পায়, সেটা মাথায় রেখে আমরা ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ পরিকল্পনা’ নিয়েছি। আগামী শত বছরে বাংলাদেশ কীভাবে উন্নত-সমৃদ্ধভাবে গড়ে উঠবে, সেটা আমরা করে যাচ্ছি। কিন্তু এটাকে ধরে রাখতে হবে। আমাদের আজকের যারা মেধাবী শিশু আগামীতে তারাই তো এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা ছোট্ট সোনামণিরা তোমরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আজকে রাসেল আমাদের মাঝে নেই। রাসেলকে আমি হারিয়েছি। কিন্তু এই রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের মাধ্যমে আমি হাজার-হাজার, লাখো-লাখো রাসেলকে পেয়েছি। আমার দোয়া, আমার আশীর্বাদ সব সময় তোমাদের সঙ্গে থাকবে। তোমরা ভালো থাক, সুন্দর জীবন পাও, উন্নত জীবন পাও সেটাই আমরা চাই।

(শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে ১৮ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত ভাষণের সম্পাদিত অংশবিশেষ)

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর