বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

মনের ওপর চাপ বাড়ছে গৃহিণী বয়স্ক ও শিশুদের

সমাজে বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ববোধ চলে এসেছে

জিন্নাতুন নূর

করোনা মহামারীতে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী অবস্থায় কাটছে বিভিন্ন বয়সী মানুষের। তবে বিভিন্ন বয়সীদের মধ্যে বয়স্ক, শিশু ও গৃহিণীদের মনের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ছে। বয়স্কদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের ঘরের বাইরে এখন পা রাখার সুযোগ নেই। অন্যদিকে আগের চেয়ে কাজ বেশি বেড়ে যাওয়ায় মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে গৃহিণীদেরও। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বদ্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে শিশুরা অনেকটাই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, মেজাজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন গৃহিণীরাও। আর ঘরবন্দী থেকে মৃত্যুভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে বয়স্ক নারী-পুরুষের। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা  বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর শিশু, বয়স্ক ও গৃহিণীরা এক ধরনের ঘরবন্দী অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কভিড-১৯ এর সংক্রমণের কারণে প্রতিদিনই বয়স্কদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি বয়স্কদের তুলনামূলক বেশি মৃত্যুহার অন্য বয়স্কদের মধ্যেও মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। অনেক শিশু এরই মধ্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। আবার গৃহিণীদের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ঘরবদ্ধ জীবনে থেকে শিশুদের পক্ষে বেশি দিন মানসিকভাবে সুস্থ থাকাও সম্ভব নয়। আবার বয়স্করাও দীর্ঘদিন ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। অনেক বয়স্ক ব্যক্তির সন্তান, যারা কাজের জন্য দূরে থাকেন, তারাও দীর্ঘ সময় তাদের মা-বাবার কাছে যেতে পারছেন না। আবার গৃহিণীরা আগে মার্কেট বা আত্মীয়দের বাড়িতে যেতে পারলেও এখন সেটিও পারছেন না। এতে সমাজে চরম বিচ্ছিন্নতাবোধ, একাকিত্ববোধ চলে আসছে। এখন সবাই এ অবস্থার উত্তরণ কবে হবে তা জানার জন্য মুখিয়ে আছেন। সবাই ‘সামাজিকভাবে অক্সিজেনহীন’ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও ঢাকার আবাসিক এলাকা ও হাঁটার পার্কগুলোতে দল বেঁধে সকাল-বিকাল বয়স্ক নারী-পুরুষদের হাঁটতে দেখা যেত। কেউ কেউ নাতি-নাতনিকে নিয়েই বিকালে বাসার সামনে থেকে একটু ঘুরে আসতেন। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর শরীরচর্চা বন্ধ করতে হয়েছে বয়স্ক নাগরিকদের। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, লকডাউনের নিষেধাজ্ঞার কারণে শিশুরা বাইরে যেতে না পেরে এক ধরনের দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে আছে। অথচ করোনার আগে শিশুরা সারাদিন স্কুল, কোচিং এবং বিভিন্ন ধরনের চর্চা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। শিশুরা এখন তাদের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছে না। ইন্টারনেটেই বেশি সময় কাটাচ্ছে। ফলে শিশুদের জীবনে এক ধরনের বিরক্তি চলে এসেছে। জীবনে কোনো বৈচিত্র্য না থাকায় শিশুরা একটি স্থবির জীবনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়া সবসময়ই আনন্দের বিষয়। তারা স্কুলে যাবে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, মাঠে খেলবে, শিক্ষক-শিক্ষিকার আদর পাবে। কিন্তু দীর্ঘ সময় স্কুলে যেতে না পেরে তারা হতাশ ও বিরক্ত। হতাশা থেকে তাদের রাগ হচ্ছে, অল্পতে খেপে যাচ্ছে, তারা পড়তে চাচ্ছে না এবং মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, হতাশাগ্রস্ত শিশুদের জন্য এখন বিকল্প উপায় হলো অনলাইন ক্লাস। কিন্তু সবাই এই সুবিধা পাবে না, কারণ গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধা নেই।

রাজধানীর রামপুরার ষাটোর্ধ্ব জীবুন্নেছা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের আগে নিয়ম করে রোজ সকাল-বিকাল হাঁটতে বের হতাম। ছোট নাতনিকে নিয়ে আশপাশে বেড়াতে যেতাম। কিন্তু ছেলেরা স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। ঘরের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি। মন খারাপ লাগলে বারান্দায় গিয়ে কিছু সময় বসে থাকি।’

পল্লবী আবাসিক এলাকার কেজি শ্রেণির ছাত্র আয়ান ফারুক। করোনার কারণে এখন অনলাইনে চলছে আয়ানের স্কুলের ক্লাস। কিন্তু অনেক দিন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পেরে তার মন খারাপ। আগে ছুটির দিনে মা-বাবার সঙ্গে ঘরের কাছে রেস্টুরেন্টে প্রিয় খাবার খেত শিশুটি। কিন্তু কয়েক মাস ধরে সেটিও বন্ধ। আয়ান বলে, ‘বাসায় বেশির ভাগ সময় ছবি আঁকি। কিন্তু বাইরে খেলতে যেতে না পেরে আর ভালো লাগে না।’

রাজধানীর মগবাজারের গৃহবধূ রত্না আক্তারের মেজাজ বেশ কিছুদিন ধরে খিটখিটে। বুয়া না আসায় ঘরের সব কাজ এখন রত্নাকে একাই করতে হচ্ছে। দুই ছেলের স্কুল বন্ধ থাকায় কিছুক্ষণ পরপরই ছেলেদের জন্য খাবার বানিয়ে দেওয়া, তাদের পড়াশোনার দেখভাল রত্নাকে একা করতে হচ্ছে। কথা হলে রত্না বলেন, ‘বুয়ার কাজগুলো আমাকেই করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সন্তানদের দেখতে হচ্ছে। নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য আর সময় পাচ্ছি না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর