রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

অসুস্থ এবং সফররত ব্যক্তিদের রোজা

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

অসুস্থ এবং সফররত ব্যক্তিদের রোজা

করোনার সংক্রমণে গোটা বিশে^র সঙ্গে বাংলাদেশেও অসুস্থতায় ভুগছেন অনেকেই। জীবনঘাতী এই মহামারীতে ঘরে ঘরে রোগ শোক  থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা চলছে। অসুস্থ এবং সফররত ব্যক্তিদের রোজা পালন প্রসঙ্গে আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘(তাও আবার সারা বছরের জন্য নয়, রোজা ফরজ করা হয়েছে) হাতে গোনা কয়েক দিনের জন্য। (তার পরেও তোমাদের) কেউ যদি অসুস্থ হয়ে যায় কিংবা কেউ যদি সফরে থাকে সে ব্যক্তি সমপরিমাণ দিনের রোজা (সুস্থ হয়ে গেলে অথবা সফর থেকে ফিরে এলে) পরে আদায় করে নেবে। এরপরও যাদের জন্য রোজা রাখা একান্ত কষ্টকর ব্যাপার বলে মনে হবে তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্যদান করবে। যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সৎকর্ম করে তার জন্য তা কল্যাণকর হয়। আর যদি রোজা রাখ তবে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণকর, যদি তোমরা তা বুঝতে পার’। (সুরা বাকারা আয়াত-১৮৪)। অসুস্থতার কারণে কিংবা ভ্রমণরত অবস্থায় রোজা পালন করা কষ্টদায়ক হলে সে ক্ষেত্রে অন্য সময়ে অনুরূপ সংখ্যক (অর্থাৎ যে কটি রোজা পালন করা সম্ভব হয়নি) রোজা অবশ্যই পালন করার কথা বলা হয়েছে। সে রোজা পালনও সম্ভব না হলে ফিদায়া হিসেবে গরিব মিসকিনকে খাদ্যদানের মাধ্যমে তা পূরণের সুযোগ রয়েছে। তবে সম্ভব হলে (অর্থাৎ কষ্টদায়ক না হলে) রোজা পালন করা ‘বিশেষ কল্যাণকর’ হবে বলে আয়াতের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বসহকারে লক্ষণীয়। রোজার ব্যাপারে ইসলামের প্রধানতম সংস্কার হলো এর বাস্তবিকতা এবং ধারণাগত পরিবর্তন। অসুস্থতা কিংবা সফরের কারণে শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, শ্রান্তি ও অবসাদে রোজাদার যাতে সব ধরনের হুকুম-আহকাম পালন করে যথার্থভাবে ইবাদত করতে অসুবিধার সম্মুখীন না হয় সে জন্য অসুস্থতা ও সফরকালে রোজা পালন থেকে অব্যাহতির বিধান দেওয়া হয়েছে। বস্তুত রোজা পালনের মাধ্যমে রোজাদার যাতে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা এবং চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা অর্জনসহ রুহানি তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করে সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। অসুস্থ ব্যক্তি বলতে তাফসিরে মারেফুল কোরআনে বলা হয়েছে রোজা রাখতে যার কঠিন কষ্ট হয় অথবা রোগ মারাত্মক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাফসিরে ফি জিলালিল কোরআনে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে- যে কোনো বিশেষ রোগ-ব্যাধির উল্লেখ করে অসুস্থ ব্যক্তির রোজা কাজা করার নির্দেশের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি। যে কোনো রোগ যাতে রোজা রাখা তার জন্য দুরূহ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রের জন্য এই অনুমতি। প্রকৃত প্রস্তাবে অসুস্থ ব্যক্তি যদি রোজা রাখার কারণে কোনো শারীরিক ক্ষতি বা মৃত্যুর আশঙ্কা বোধ করে তবে এ অবস্থায় রোজা রাখবে না। সুস্থ হওয়ার পর কাজা করবে। শুধু মনের ধারণায় অসুস্থতার অজুহাতে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকা সমীচীন  নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অথবা নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা কোনো লক্ষণ দ্বারা প্রবল ধারণা জন্মে যে, রোজা রাখলে ক্ষতি হবে তখন রোজা রাখা ত্যাগ করা যাবে। ‘সফররত ব্যক্তি’ বলতে কোরআনের তাফসিরকারক এবং শরিয়তের পরিভাষাবিদগণ ব্যাখ্যা করেছেন যে ওই ব্যক্তি যিনি সফরে আছেন। বাড়িঘর হতে বের হয়ে কোথাও যাওয়া নয়, সফর দীর্ঘ হতে হবে। রসুলে করিম (সা.)-এর হাদিস এবং সাহাবিদের অনুসরণের ওপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানিফা (র.) এবং অন্যান্য ফেকাহবিদগণ সফরের দূরত্বকে তিন মনজিল বলে মতপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ একজন লোক স্বাভাবিকভাবে পায়ে হেঁটে তিন দিনে যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে ততটুকু দূরত্বকে বোঝায়। পরবর্তীকালের ফেকাহবিদগণ এ দূরত্বকে ৪৮ মাইল সাব্যস্ত করেন। মহানবী (সা.)-এর হাদিস মতে সফরের সময়সীমা বলতে সফরকালীন সময় এবং মধ্যবর্তী যাত্রাবিরতির মেয়াদ ঊর্ধ্বপক্ষে ১৫ দিনের কম সময়কে বোঝায়। কেউ যদি সফরের মধ্যেই কোথাও ১৫ দিন অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন সেটা আর সফরের মধ্যে বিবেচিত হবে না। সফরের দূরত্ব এবং অবস্থানের মেয়াদ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায় বিজ্ঞানের বদৌলতে এখন স্বল্প সময়ে প্রায় বিনা ক্লেশে অনেক দূরের পথ অতিক্রম করা সম্ভব এবং অবস্থান ক্ষেত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতীতের মুসাফিরের মতো নয়। রোজা পালনের ক্ষেত্রে অতীতে যে প্রেক্ষাপটে বিশেষ বিবেচনা প্রযোজ্য ছিল আধুনিককালে তা অবস্থা অনুযায়ীই প্রযোজ্য হবে। যে সফর সমস্যাসংকুল এবং রোজা পালনের জন্য অনুকূল নয় সে সফরের দূরত্ব ও সময়সীমা সে আলোকেই বিবেচিত হবে। আল্লামা ইউসুফ আলীর ভাষ্য মতে- There are various degrees of fatigue in riding a given distance on horseback or by a camel or in a comfortable train or by motor car or by a steamer, aeroplane, or airship. In my opinion the standard must depend on the means of locomotion and on the relative resources of the traveller. It is better to determine it in each case according to circumstances. সে কারণে যেনতেন সফরের দোহাই দিয়ে রোজা পালনে বিরত থাকবার হাল্কা ব্যাখ্যা বা অজুহাত দাঁড় করার অবকাশও নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ অর্জনের জন্য তার দেওয়া ফরজ বিধান রোজা পালন সৌভাগ্যেরই বিষয়। সুতরাং সে রোজা পালনে বিরত থাকার কোনো উপায় ও উপলক্ষ খোঁজা আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর