শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গাইবান্ধায় অনিয়মকারীরা চিহ্নিত

ইসি অনুমান করতে পেরেছে কাদের নির্দেশে অনিয়ম অন্যায়। কর্মকর্তারা তাদের পরিচয় না দেওয়ায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না। গোয়েন্দারা কেন আগে তথ্য পেলেন না বোধগম্য নয় - ইসির পর্যালোচনা

গোলাম রাব্বানী

গাইবান্ধায় অনিয়মকারীরা চিহ্নিত

বন্ধ ঘোষিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ১৪৫ কেন্দ্রের মধ্যে ১২৫টিতে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। চিহ্নিত করা হয়েছে অনিয়মকারীদের। তবে সাক্ষীর অভাবে পর্দার আড়ালের দোষীদের চিহ্নিত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

নির্বাচনী দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ ও অনিয়মে সম্পৃক্ততার কারণে গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), রিটার্নিং অফিসার, পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তা, একজন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, ১২৫ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও নির্বাচনী এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত

 নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে। গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের কাছে ইসির সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। এ সময় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান ও ইসি সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত ছিলেন।

সিইসি জানান, দায়িত্বে অবহেলার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি পুলিশের পাঁচজন এসআইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হবে। ১২৫ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে, এডিসি ও একজন নির্বাহী হাকিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবে ইসি। আর ১৪৫ কেন্দ্রের নির্বাচনী এজেন্টদের আর কখনো ভোটের দায়িত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, সুপারিশ অনুযায়ী সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কি না, এক মাসের মধ্যে তা কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে।

অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে ইসির পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ইসি অনুমান করতে পেরেছে কাদের নির্দেশে তারা (কর্মকর্তারা) এমন অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু কর্মকর্তারা তাদের পরিচয় না দেওয়ায় কমিশন আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যে কৌশল প্রয়োগ করে তথ্য আদায় করা হয়, তদন্ত কর্মকর্তাদের সেই সুযোগ না থাকায় পর্দার আড়ালের দোষীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। এ ছাড়া গাইবান্ধার গোয়েন্দা পুলিশ কেন এ পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে জানতে পারেনি বা রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের জানায়নি তা বোধগম্য নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- তদন্ত কমিটি জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশের ওসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। তবে কমিশন মনে করে, রিটার্নিং কর্মকর্তা তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি। তিনি দায়িত্ব পালন করলে প্রাথমিক পর্যায়েই এসব অনিয়ম প্রতিরোধ করা যেত। তাই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইসি তাদের পর্যালোচনায় বলেছে- দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় এ ধরনের অনিয়মগুলো অনেকটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। একটি ভোট কেন্দ্রের অনিয়মের ভিডিও ফুটেজ দেখানোর পর কর্মকর্তাদের সবাই বলেছেন, এটা ধরলে অপরাধ না ধরলে কিছুই না। এতে স্পষ্ট হয় যে দেশে নির্বাচনে অনিয়ম করাটাই যেন স্বাভাবিক বিষয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- নির্বাচনের দিন সব কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা ভালো ছিল। কিন্তু ভোট কেন্দ্রের ভিতরের অবস্থা ছিল পুরোপুরি উল্টো। ভোটকক্ষে এবং ভোটদানের গোপন কক্ষে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। সেখানে ভোটার তার পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারেননি। এজেন্ট ও অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা ভোট দিয়েছেন। এ নির্বাচনের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই একই ধরনের অনিয়ম করা হয়েছে। এটি সমন্বিত ও সুপরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তের সময় কোনো এজেন্ট, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা স্বীকার করেননি তারা কেন বা কার আদেশে এমন করেছেন। সবাই কমিটিকে বলেছেন, তারা স্বেচ্ছায় এ ধরনের অন্যায় কাজ করেছেন। তবে তদন্ত কমিটি মনে করে, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা স্থানীয় বাসিন্দা। তারা যাদের আদেশে বা চাপে এ ধরনের কাজ করেছেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করলে জীবনের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। তার চেয়ে ইসি অন্যায়ের শাস্তি দিলে আর যা হোক জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে না। এ ধরনের মানসিকতা তাদের মধ্যে কাজ করেছে বলে কমিটি মনে করে। ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের মধ্যে সিসি ক্যামেরায় অনিয়মের দৃশ্য দেখে মাঝপথে ঢাকা থেকে নির্বাচন বন্ধের নির্দেশ দেয় ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অনিয়মে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করতে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে অনিয়মের কারণে কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচন বন্ধ করার ঘটনা এটাই প্রথম।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও ইসির ১০ সিদ্ধান্ত : ১২৫ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। তাদের নামের তালিকা ইসি সচিব নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের স্ব-স্ব নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবেন। নিয়ন্ত্রণকারী/নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে অবহেলা তথা অসদাচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করবে। কেন্দ্র নম্বর ৯৪-এর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম, প্রভাষক উদয়ন ডিগ্রি কলেজকে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫(৩) অনুযায়ী চাকরি থেকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে। সচিব, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এক মাসের মধ্যে কমিশনকে অবহিত করবে মর্মে পত্র দেবে। একইভাবে এ উপনির্বাচনের কেন্দ্র নম্বর ২-এ দায়িত্বে থাকা (তরুণ কুমার, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৪ (মো. আবদুল্লাহ আল মামুন, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৫৯ (মো. আনিছুর রহমান, এসআই গোবিন্দগঞ্জ থানা), কেন্দ্র নম্বর ৬২ (কনক রঞ্জন বর্মণ, এসআই সাদুল্যাপুর থানা) ও কেন্দ্র নম্বর ১০৫ (মো. দুলাল হোসেন, এএসআই, আটোয়ারী থানা, পঞ্চগড়)-এর পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা তথা অসদাচরণের কারণে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবেন ইসি সচিব। কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুশান্ত কুমার সাহার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুসারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অসদাচরণের জন্য ব্যবস্থা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে এক মাসের মধ্যে অবহিত করার জন্য ইসি সচিব চিঠি দেবেন। ইসি সচিবালয় সহকারী কমিশনারের নাম জেনে (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট। তদন্ত প্রতিবেদনে নাম উল্লেখ করা হয়নি) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবৈধ আদেশ পালন করায় তাকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে চিঠি দেবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের (আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, রাজশাহী) বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য তার বিরুদ্ধে ইসি সচিব বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তবে এক মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে কমিশনকে অবহিত না করলে কমিশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬ (২) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া সব কেন্দ্রের দায়িত্ব পালনকারী নির্বাচনী এজেন্টদের তালিকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কর্তৃক সিলকৃত ব্যাগে রয়েছে, যেহেতু নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে এবং এ বিষয়ের ওপর আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই তাই যেসব কেন্দ্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে সেসব কেন্দ্রের ব্যাগ খুলে দায়ী এজেন্টদের একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, গাইবান্ধা এ তালিকা করবেন। দোষী নির্বাচনী এজেন্টদের পরবর্তী নির্বাচনে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। ভবিষ্যতে নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোরতম ধারায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আগামী সপ্তাহে পুনঃ ভোটের তারিখ : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, পুনঃ ভোটের তারিখ আগামী সপ্তাহে জানানো হবে। খুবই সংক্ষিপ্ত একটি সময় দেওয়া হবে। ভোটের একটি দিন দিয়ে পুনঃ ভোটের সময় জানানো হবে। তিনি জানান, কবে ভোট হবে ও কারা দায়িত্বে থাকবেন তা জানানো হবে। সব প্রার্থী আগের মতোই থাকবেন।

সর্বশেষ খবর